যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে সিপিএম এবং কংগ্রেস।সিপিএমের তরফে জানানো হয়েছে, আলিপুরদুয়ার বিধানসভা কেন্দ্রে তারা কংগ্রেস প্রার্থী বিশ্বরঞ্জন সরকারকেই (ডান দিকে) সমর্থন করবে। বৃহস্পতিবার নারায়ণ দে-র তোলা ছবি।
সাদা চোখে তালিকা দেখলে দু’পক্ষেরই প্রার্থীর নাম রয়েছে বেশ কিছু আসনে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে লাগাতার আলোচনায় এক পক্ষ জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে অন্য পক্ষকে। তৃণমূলকে হারানোর জন্য যেখানে যে শক্তিশালী, তাকেই সামনে রেখে পিছনে চলে যাচ্ছে বাকিরা। যদিও এই নীতি নিয়ে চলতে গিয়ে বামফ্রন্টের মধ্যে ঠোকাঠুকি লাগছে। বাম শরিকেরা প্রশ্ন তুলছে, দু’মাসের বন্ধুর জন্য চল্লিশ বছরের সঙ্গীকে ছেড়ে দেওয়া কি মেনে নেওয়া যায়?
রা কাড়ছেন না সিপিএম নেতৃত্ব! তাঁদের কথা একটাই। লক্ষ্য এখন তৃণমূলকে আটকানো। বাকি সব গৌণ।
এই কৌশলে এগোনোর পথে বৃহস্পতিবার কোনও রাস্তায় কাঁটা পরিষ্কার হয়েছে। কোথাও আবার গর্ত একটু গভীর হয়েছে। তবু হাল ছাড়তে নারাজ আলিমুদ্দিন। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘বারবার বলছি, একটা সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। কিছু অসুবিধা হবেই। কিন্তু শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি।’’
বাম ও কংগ্রেসের ঘোষিত তালিকা ধরে বিচার করলে মোট ২২টি আসন এমন ছিল, যেখানে দু’পক্ষেরই প্রার্থী আছে। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটি বুধবার সন্ধ্যায় উত্তর ২৪ পরগনার বাগদা আসনের প্রার্থী হিসেবে প্রাক্তন বিধায়ক দুলাল বরের নাম ঘোষণার পরে সেই সংখ্যা পৌঁছেছিল তেইশে। ওই আসনে আগেই প্রার্থী দিয়েছিল ফরওয়ার্ড ব্লক। এ দিন ফব পাল্টা প্রার্থী দিয়েছে মুর্শিদাবাদ আসনে। ফলে, বিতর্কিত আসনের সংখ্যা হয়েছে ২৪।
উল্টো দিকে, এ দিনই ইঙ্গিত মিলেছে, বীরভূমের সাঁইথিয়া আসনটি শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস ছেড়ে দিচ্ছে সিপিএমকে। ওই কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন সিপিএমেরই। দলের রাজ্য নেতৃত্বের ইঙ্গিত পেয়ে তিনি আবার প্রচারও শুরু করে দিয়েছেন। ঠিক তেমনই দুর্গাপুর পশ্চিম আসনে সিপিএম প্রার্থী বিপ্রেন্দু চক্রবর্তীর মনোনয়নপত্র টেকনিক্যাল কারণে বাতিল হয়ে গিয়েছে। ওই আসনে তাই কংগ্রেস প্রার্থীই থাকছেন। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, ‘‘মানুষের মধ্যে এবং নিচু তলায় নিখুঁত বোঝাপড়ার জন্য প্রবল চাপ আছে। উপর থেকে কিছু চাপিয়ে দিলেই হবে না। স্থানীয় স্তরে নিজেদের মতো করে বোঝাপড়া হয়ে যাচ্ছে। আমাদের তাই সব সময় নমনীয় হয়ে থাকতে হচ্ছে। এটা বাম শরিকদেরও বুঝতে হবে।’’
শরিকদের মধ্যে সঙ্কট সব চেয়ে বেশি আরএসপি-র। তারা এ বার যে ১৯টি আসনে লড়ছে, তার মধ্যে ৯টিতেই কংগ্রেসের প্রার্থী আছে। যার অন্যতম, আলিপুরদুয়ার আসনে (গত বার কংগ্রেসের জেতা) কংগ্রেস প্রার্থী বিশ্বরঞ্জন সরকারকে সমর্থন করার কথা এ দিন ফের ঘোষণা করে দিয়েছেন সিপিএমের আলিপুরদুয়ার জেলা নেতৃত্ব। অথচ ওই আসনে বামফ্রন্টের তরফে ঘোষিত প্রার্থী আরএসপি-র নির্মল দাস।
এই অবস্থায় ‘ব্যথিত’ আরএসপি নেতৃত্ব বৃহস্পতিবার রাতে আলিমুদ্দিনে আলোচনায় বসেছিলেন বিমান বসুর সঙ্গে। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যানের কাছে তাঁরা ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। বৈঠকের পরে আরএসপি-র রাজ্য সম্পাদক ক্ষিতি গোস্বামীর বক্তব্য, ‘‘আমরা যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছি, বামপন্থী দলে একটা শৃঙ্খলা থাকে। উঁচু তলায় যা সিদ্ধান্ত হয়, নিচু তলায় সেটাই মানা হয়। নতুন যারা প্রার্থী হল, তাদের দলীয় কার্যালয়ে (কংগ্রেস) বসে সিপিএমের জেলা নেতৃত্ব ওদের সমর্থনের কথা ঘোষণা করে দিলেন, এটা কী ভাবে মানা যায়?’’ বিমানবাবু বৈঠকে আশ্বাস দিয়েছেন, বিষয়টি তিনি দেখবেন। আর ক্ষিতিবাবুরা জানিয়ে দিয়েছেন, বিমানবাবুরা না মানলে আলিপুরদুয়ারে নির্মলবাবু তাঁদের প্রার্থী থাকবেন।
তবে রাজ্য সিপিএম সূত্রে বলা হচ্ছে, ক্ষিতিবাবুরা যেমন বলছেন, সেই ভাবে এ বার আর ভোটের রথ চলছে না! নিচু তলার মনোভাব দেখেই উপর তলাকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। তা ছাড়া, আলিপুরদুয়ার কংগ্রেসেরই জেতা আসন। তাই আরএসপি-র দাবি সেখানে মেনে নেওয়া কঠিন। একই যুক্তিতে কংগ্রেসেরও আরএসপি-কে মালতীপুর, ভরতপুর বা ফ ব-কে হরিশ্চন্দ্রপুর ছে়ড়ে দেওয়া উচিত বলেও সিপিএম নেতৃত্বের মত।
কংগ্রেসের তরফেও এ দিন বলা হয়েছে, মীমাংসা-সূত্র বের করতে তারা সব রকম চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রদেশ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের কথায়, ‘’২২-২৩টি আসনে এখনও জট কাটেনি। তবে দু’টো বিপরীতমুখো ভাবনাকে একটা অভিমুখে আনতে সময় লাগে! দিল্লি এবং কলকাতা দু’জায়গা থেকেই দু’তরফে আলোচনা চলছে।’’ আলোচনার মাঝেই স্নায়ুর চাপ বজায় রাখার জন্য বামফ্রন্ট যেমন মুর্শিদাবাদ আসনে বিভাস চক্রবর্তীকে ফ ব-র প্রার্থী ঘোষণা করেছে, তেমনই বাগদায় মৃণাল সিকদারের বদলে অশোক বিশ্বাসের নাম দেওয়া হয়েছে। যদিও সেলিমের বক্তব্য, ‘‘তৃণমূলের বিরুদ্ধে যারা লড়বে, তাদের মধ্যে কোনও বিরোধ থাকবে না। এখনও তো মনোনয়ন জমা এবং প্রত্যাহারের পর্ব বাকি আছে!’’
গত বছর কলকাতা পুরভোটের আগে দক্ষিণ কলকাতা কংগ্রেসের সহ-সভাপতি প্রবীর রায় দল ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছিলেন।
দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ, রাসবিহারী ও ভবানীপুর কেন্দ্রের শ’দেড়েক বিজেপি কর্মী নিয়ে ফের কংগ্রেসে ফিরেছেন তিনি। প্রবীরবাবু বলেন, ‘‘তৃণমূলের হাত থেকে রাজ্যকে বাঁচাতে কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে গিয়েছিলাম। এ বার ভুল বুঝতে পেরে কংগ্রেসেই ফিরে এলাম।’’