স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে সুশান্ত দে। শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র।
ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাসে বাঘা যতীন, হরিদেবপুর, বেহালা, বালিগঞ্জকেও যেন ছাপিয়ে গেল বেলেঘাটা। অভিযোগ, বৃহস্পতিবার রাতে বেলেঘাটার নবাব বাগানে এক সিপিএম কর্মীর বাড়িতে ঢুকে তাঁকে মারধর করার পাশাপাশি দুষ্কৃতীরা রেহাই দেয়নি তাঁর ১৭ বছরের প্রতিবন্ধী ছেলেকেও। তাকে লক্ষ করে লাঠি চালালে দ্বাদশ শ্রেণির ওই ছাত্র বুকে আঘাত পায়। এমনিতেই জন্ম থেকে বাঁ পায়ে সমস্যা থাকায় সে ঠিক মতো হাঁটতে পারে না। ওই সিপিএম কর্মীর বারো বছরের ভাইঝি ও স্ত্রীকেও শারীরিক নিগ্রহ করা হয়েছে বলে অভিযোগ। শুধু তা-ই নয়, ১৯ মে ভোটের ফল বেরোনোর পরে সুশান্তবাবুর বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
আগের প্রতিটি ঘটনার মতো এ বারও অভিযোগের তির শাসক দল তৃণমূলের দিকে। আর পুলিশেরই একাংশের মতে, সম্ভবত সেই কারণেই সিপিএম কর্মী সুশান্ত দে-র সপরিবার আক্রান্ত ও নিগৃহীত হওয়ার ঘটনায় অভিযুক্তদের কাউকে পুলিশ গ্রেফতার করতে না পারলেও শুক্রবার সন্ধ্যায় সুশান্তবাবুকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। রাত পর্যন্ত তিনি জামিনে ছাড়া পাননি। ফলে, এক দিকে শাসক দলের সন্ত্রাস যেমন অব্যাহত, তেমনই অন্য দিকে শিরদাঁড়া ফের বাঁকা করে ফেলা পুলিশের জন্য সাধারণ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ।
পুলিশেরই একাংশের বক্তব্য, ভোটের সময়ে নির্বাচন কমিশনের কড়া নজরদারি ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতির কারণেই মনে হচ্ছিল যেন পুলিশের মেরুদণ্ড সোজা হয়েছে। এখন ফের যে কে সে-ই। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার জেরে যেমন দুষ্কৃতীরা দৌরাত্ম্য চালাচ্ছে, তেমনই আবার অভিযুক্তদের ধরার বদলে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধেই পুলিশ আইনি পদক্ষেপ করছে।
তবে তৃণমূলের পাল্টা অভিযোগ, সুশান্তই নবাব বাগান তল্লাটে গৌতম দাস নামে তৃণমূলকর্মী এক অটোচালককে মারধর করে তাঁর হাত ভেঙে দিয়েছেন। সেই অভিযোগ থানায় জানানোর পরেই ওই সিপিএম কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। সুশান্তবাবুর বাড়ি ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে। স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর আশুতোষ দাস বলেন, ‘‘সুশান্ত সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ করছেন। উনিই তো সিপিএমের হার্মাদ। আমাদের কর্মী গৌতম দাসের হাত ভেঙে দিয়েছেন।’’
বেলেঘাটা কেন্দ্রে ১৮১ নম্বর বুথে সিপিএম প্রার্থী রাজীব বিশ্বাসের এজেন্ট ছিলেন সুশান্ত দে। রাজীববাবু বলেন, ‘‘প্রশাসন যদি এ ভাবে কাজ করে, তা হলে তা দুর্ভাগ্যজনক।’’
কী ঘটেছিল ওই রাতে? সুশান্তবাবু ও তাঁর আত্মীয়দের বক্তব্য, বৃহস্পতিবার রাত ১১টা নাগাদ বাড়ির সদর দরজা ঠেলে বাড়ির ভিতরে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে তৃণমূলের কয়েক জন। নবাব বাগানে তাঁর পরিবারের সঙ্গে থাকেন তাঁর আরও দুই ভাইয়ের পরিবার। ওই যুবকেরা বাড়ি ঢুকতেই সকলে ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে চলে আসেন। সুশান্তবাবুর নাম করে অকথ্য গালিগালাজ চলে। অভিযোগ, সুশান্তবাবু সামনে এগিয়ে গেলে ওই চার যুবকের মধ্যে এক জন হাতে থাকা একটি লাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত করে সুশান্তবাবুর বুকে। কোনও রকমে তা সামলে নিলেও পরেই অন্য একটি ঘুষি এসে পড়ে তাঁর মুখে। এর পরে শুরু হয় এলোপাথাড়ি চড়, কিল ঘুষি। এমনকী, সুশান্তবাবুকে বাড়ি থেকে টেনে বার করার চেষ্টা করা হয়।
চোখের সামনে বাবাকে এ ভাবে মার খেতে দেখে এগিয়ে আসে প্রতিবন্ধী ছেলে বছর সতেরোর শৌভিক দে। অভিযোগ, তাকে লক্ষ করেও লাঠি চালানো হলে বুকে আঘাত পায় শৌভিক। তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়। সুশান্তবাবুকে বাঁচাতে এসে কমবেশি আক্রান্ত হন সুশান্তবাবুর স্ত্রী উত্তরা দে এবং তাঁর ভাইঝি বারো বছরের রশ্মিতাও।
সুশান্তবাবু বলেন, ‘‘মত্ত অবস্থায় বাবলু সিংহ, সুকুমার সাহা, বুদো দাস ও নিখিল দাস আমাদের বাড়িতে ঢুকে তাণ্ডব চালায়। ওরা প্রত্যেকেই তৃণমূল কর্মী।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘ওই দলটি যাওয়ার সময়ে বারবার বলছিল, ১৯ মে–র পরে বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে। মারধরের হুমকিও দেয় ওরা।’’
শুক্রবার বিকেলে নীলরতন সরকার হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যে আসেন সুশান্তবাবু। সেখানে তিনি জানান, ওই ঘটনার পরেই বেলেঘাটা থানায় চার তৃণমূলকর্মীর নামে অভিযোগ দায়ের করা হয়। কিন্তু তখন এফআইআর–এর নথি তিনি পাননি। থানা থেকে সুশান্তবাবু তা নিতে গেলে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারের পর শৌভিক বলে, ‘‘আমার বাবা রাতেই অভিযোগ দায়ের করলেও পুলিশ কোনও ‘রিসিভড কপি’ দেয়নি। শুক্রবার সকালে গেলেও বাবাকে ফেরত পাঠানো হয়। তার পরে সন্ধ্যায় থানায় যেতেই গ্রেফতার করা হল। কিছুই বুঝতে পারলাম না।’’
পুলিশের বক্তব্য, অভিযোগ অনুযায়ী সব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তা হলে সুশান্তবাবুর অভিযোগের ক্ষেত্রে কী করা হচ্ছে? ডিসি (ইএসডি) ধ্রুবজ্যোতি দে বলেন, ‘সুশান্ত দে যে চার জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, তারা পলাতক। তাদের খোঁজে তল্লাশি চলছে।’’