তৃণমূলের সভায় কারও মুখে নেই মাস্ক। মানা হয়নি সামাজিক দূরত্ববিধিও। ছবি পিটিআই।
বাঙালি রাজনীতিপ্রিয়। এটা যে ধ্রুব সত্য, তা মোটামুটি সকলেই জানেন। কিন্তু সেই রাজনীতির দাম যে জীবনের থেকেও বেশি, সেটা করোনা সংক্রমণের আগে বোঝা যায়নি। দলের ‘বড়’ নেতারা ‘ছোট’ নেতাদের বলছেন, মিছিল-সমাবেশে লোক জোগাড় করে আনার জন্য। ‘ছোট’ নেতারা আবার তাঁদের অনুগামীদের নির্দেশ দিচ্ছেন লোক জোগাড়ের। ফলে লোকের জমায়েত হচ্ছে। সেই জমায়েতের মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে করোনা। সংক্রমণের ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা জেনেও তাঁরা ‘না’ বলার সাহস দেখাতে পারছেন না!
এক সমাজতাত্ত্বিকের কথায়, ‘‘মিছিল-সমাবেশে যাব না, পার্টির নিচু স্তরের কর্মীরা এটা শীর্ষে আসীন নেতাদের কিছুতেই বলতে পারেন না। এমনকি, পুরো পরিস্থিতি জেনেও!’’ ইতিহাসবিদদের একাংশ অবশ্য বাঙালির এই ‘না’ বলার সাহসের অভাবের মধ্যে ঐতিহাসিক অনুষঙ্গ খুঁজে পাচ্ছেন। তাঁদের মতে, ব্রিটিশ শাসনের মাঝামাঝি সময় থেকে বাঙালিদের একাংশ প্রতিবাদমুখী হলেও সার্বিক বাঙালি সমাজের কথা যদি ধরা যায়, তা হলে সেখানে সাহসের অভাবই লক্ষ্য করা যাবে। বিচ্ছিন্ন ভাবে রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু-সহ অন্য কিছু বাঙালি ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কিন্তু ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায়ের বক্তব্য, জাতি হিসেবে বাঙালিদের মধ্যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ‘না’ বলে গর্জে ওঠার সাহসের যে অভাব রয়েছে, তা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত একাধিক বার বলে গিয়েছেন। সেই মনোভাবই ইতিহাসগত ভাবে বাঙালিদের সঙ্গ নিয়েছে।
তবে রজতবাবুর কথায়, ‘‘এর পুরোটাই সাহসের অভাবের জন্য নয়। এর পিছনে ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার মতো কারণও রয়েছে। তার পাশাপাশি, রাজনৈতিক দলের সমর্থক হলে আত্মরক্ষা করা যাবে, এই মানসিকতা থেকেও অনেকেই মিছিল-সমাবেশে যোগদান করতে যান। যার সুবিধা সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোই নেয়।’’ আর এক ইতিহাসবিদের কথায়, ‘‘ব্যতিক্রমী বাঙালি দিয়ে কিন্তু বাঙালির সাহস আছে কি নেই, তার বিচার করা সম্ভব নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি কী ভাবছেন, কী করছেন, তার উপরেই বাঙালি মনন নির্ভর করছে।’’
অমিত শাহের র্যালিতেও মানা হয়নি দূরত্ববিধি। ছবি: পিটিআই।
রাজনৈতিক দলগুলি অবশ্য এত কিছু ভাবতে নারাজ। তাদের কাছে ভোট ‘বড় বালাই’। সে কারণে তৃণমূলের এক বিদায়ী কাউন্সিলর বলেন, ‘‘দল বললে তো যেতেই হবে। তবে যাঁরা জমায়েতে আসছেন, তাঁদেরও ভাবতে হবে যে শুধু তিনিই নন, তাঁর মাধ্যমে গোটা পরিবারই সংক্রমিত হতে পারে।’’ এক তৃণমূলকর্মী বলছেন, ‘‘পার্টি করি যখন, তখন তো যেতেই হবে। বাড়িতে বসে থাকলেও যে করোনা হবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়!’’
বাম নেতাদের একাংশের আবার বক্তব্য, এই সময়ে নির্বাচন ঘোষণা করাই তো উচিত হয়নি। তাঁদের আরও যুক্তি, মহারাষ্ট্র, দিল্লি-সহ যে সব জায়গায় সংক্রমণের হার বেশি, সেখানে তো নির্বাচন হচ্ছে না। তা হলে সেখানে করোনা সংক্রমণ এত মারাত্মক রূপ ধারণ করল কী ভাবে? সিপিএম নেতা তথা কলকাতা পুরসভার ১১১ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলর চয়ন ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘নির্বাচন একটু পিছিয়ে দিলেই প্রচার-সমাবেশের প্রয়োজন পড়ত না। কিন্তু নির্বাচন হলে আমাদেরও তো মানুষের কাছে পৌঁছতে হবে।’’ তাই বলে নিজের এবং অন্যের জীবন বিপন্ন করে? ‘‘তা না হলে তো নির্বাচন থেকেই নিজেদের উইথড্র করে নিতে হয়’’— উত্তর চয়নবাবুর। সিপিএমের এক কর্মীর কথায়, ‘‘রাষ্ট্র সংক্রমণ রুখতে নিজের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করলে এই পরিস্থিতি তৈরি হত না। এখন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের উপরে দায় চাপালে হবে না।’’
নিচুস্তরের কর্মীদের সভায় যোগদান প্রসঙ্গে আরএসএস কর্মী তথা ৮৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলর সুব্রত ঘোষ বলছেন, ‘‘ভোট বড় বালাই। জমায়েতে না বলা যায় না! তাই বাড়ছে সংক্রমণও। তবে সবার আগে মানুষের জীবন, এটা সবারই বোঝা উচিত ছিল।’’ আর বিজেপির এক কর্মীর কথায়, ‘‘আসলে রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। রাজনীতিতে এর থেকে বড় সত্যি আর কিছু নেই!’’