ভোটের চিঠিটা হাতে পেলাম। আর বাড়িতে শুরু হল গিন্নির চিন্তা। কোনও গোলমাল হবে না তো! যাই হোক, ভোটের দায়িত্ব সামলাতে ঢাউস ব্যাগ কাঁধে সকাল সকাল বর্ধমান থেকে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য, মন্তেশ্বর বিধানসভা কেন্দ্রের কালুই গ্রামে প্রাথমিক স্কুল। সেখানকার বুথে ফার্স্ট পোলিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলাম আমি।
ভোটের জিনিসপত্র বিলি ও গ্রহণ কেন্দ্র (ডিসিআরসি) ছিল কালনায়। চড়া রোদ মাথায় বেলা সাড়ে ১০টা নাগাদ কালনা পৌঁছলাম। লম্বা লাইনে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ভোটের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করা হল। এ বার তা মিলিয়ে নেওয়ার পালা। কিন্তু বসার জায়গা? দেখি মাটির উপরেই ধুলোয় ভরা প্লাস্টিকের একটা ত্রিপল পাতা। সেখানেই আমাদের দলের অন্যান্য ভোটকর্মীদের সঙ্গে ভোটের সরঞ্জাম মিলিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হল। গোড়াতেই বিপত্তি। মিলছে না ভোট-রেজিস্টার! খোঁজ খোঁজ। কিন্তু কারও ব্যাগে রেজিস্টার খাতাটি নেই। প্রশাসনের দু’-এক জন কর্তাও তার হদিস দিতে পারলেন না। শেষমেশ ঠিক হল, অন্য একটা কাউন্টার থেকে খাতা দেওয়া হবে। রেজিস্টার-খাতা যতক্ষণে হাতে পেলাম, সূর্য ততক্ষণে পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। দেখা মিলল সেক্টর অফিসারের। এ বার গন্তব্য মন্তেশ্বরের কালুই গ্রামের ভোটকেন্দ্র।
কিন্তু যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট বাসটাই যে মিলছে না! বিস্তর তল্লাশির পর দেখা মিলল বাসের। বাসের গায়ে লেখা ‘উখড়া থেকে কুমারডিহি’। বাসে উঠে বেশ মজা হল। আগে-পিছে ‘এসকর্ট’ করে ভোটকর্মীদের বাস চলেছে গন্তব্যে। কিন্তু উখড়া-কুমারডিহি রুটের বাসটি কী আর এত নিয়ম বোঝে? কখনও আগে চলে যায়, কখনও আবার বেশ খানিক কদম পিছিয়ে পড়ে। আচমকা এক ভোটকর্মী বলে উঠলেন, ‘‘আজ তো যাত্রী তোলার ব্যাপার নেই। ঠিক ভাবে চলুন।’’ কিন্তু বাসের গতি দেখে মনে হল অনভ্যাসের ফোঁটা কপালে চড়চড় করছে!
ধাত্রীগ্রাম, পূর্বস্থলী, সমুদ্রগড়, নাদনঘাট পেরিয়ে গেল বাস। ছাড়িয়ে গেলাম মন্তেশ্বর, মালডাঙাও। শুরু হল গায়ে, মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা। আর কদ্দুর? শুনলাম, চলেই এসেছি প্রায়। কিন্তু কোথায় কী? বাসের সামনে চলা সেক্টর অফিসারের গাড়িটা হঠাৎ থামল। অফিসার জানালেন, ‘‘একটি ভুল হয়ে গিয়েছে। আমরা প্রায় দেড় কিলোমিটার এগিয়ে চলে এসেছি।’’ শেষমেশ বাস থামল। ভাবলাম এ বার নিশ্চিন্ত। কিন্তু ফের বিপত্তি। নির্দেশ এল, প্রায় দেড় কিলোমিটার পায়ে হেঁটে কালুই গ্রামের ভোটকেন্দ্রে যেতে হবে। সব ভোটকর্মীরা বিদ্রোহ করে বসলেন। সকলে সমস্বরে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন, ‘‘দিনে এসকর্ট দিয়ে নিয়ে আসা। আর আঁধারে পাহারা নেই! বাসেই বসে থাকব।’’ শেষমেশ রাত ৭টা ৪৫-এ পুলিশকর্মীরা গাড়ি করে আমাদের ভোটকেন্দ্রে পৌঁছে দিলেন।
ভোটকেন্দ্রে আগেভাগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা। তাঁরা আমাদের রাতে থাকার ঘরটা দেখিয়ে দিলেন। দরজা খুলতেই একরাশ ঝুল আর ধুলো। কাছেই পড়ে থাকা খড় দিয়ে কোনও রকমে জায়গাটা অল্প পরিষ্কার করা গেল। আর শরীর দিচ্ছিল না। শতরঞ্জি বিছিয়ে বসে পড়লাম। রাতের খাওয়াটাও জুটে গেল।
তবে উপরি সমস্যা হিসেবে এ বার যোগ হল বেহাল বিদ্যুৎ সংযোগ। মোমবাতির জ্বেলেই খানিক কাজকর্ম সেরে ফেললাম আমরা। ঘুমোতে যাব, এমন সময় বিপুল আওয়াজ! প্রবল নাসিকা গর্জন করে চলেছেন প্রিসাইডিং অফিসার। লাটে উঠল ঘুম! ভোর রাতেই উঠে পড়লাম। সব গুছিয়ে বসতেই চলে এলেন প্রধান রাজনৈতিক দলের এজেন্টরা। সকাল ছ’টার মধ্যেই বুথের সামনে লম্বা লাইন। ভোট শেষ হল সন্ধ্যা ছ’টায়।
জিনিসপত্র সব জমা দিয়ে এ বার ফেরার পালা। রাত সাড়ে ১২টায় বাড়ি পৌঁছলাম। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন গিন্নি। চেয়ে দেখি ডাইনিং টেবিলে সাজানো রয়েছে মাছের ঝোল, আলু-পোস্ত আর গরম ভাত!
(লেখক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থণ বিভাগের কর্মী)