আফশোস: সেই বৃদ্ধ মামার ঘর আগলে ভাগ্নে ধীরজ এবং তাঁর স্ত্রী গঙ্গা। শুক্রবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
মানিকতলার তৃণমূল প্রার্থীর সমর্থনে বিশাল করে দেওয়াল লেখা হয়েছে টালির ঘরের গায়ে। কিন্তু সেই ঘরের বাসিন্দা ভোটারের খোঁজ নেই কারও কাছেই। ভোটপ্রার্থী তো দূর, এলাকার মানুষও ঠিক করে বলতে পারেননি তিনি কোথায়! স্থানীয় থানায় খোঁজ নিলে শুধু জানা যায় গত মার্চে করোনাকালের একটি ঘটনার কথা। জানা যায়, ওই ঘটনার পর থেকেই তিনি নিখোঁজ!
হরিশ নিয়োগী রোডের বাসিন্দা, বছর সত্তরের সেই বৃদ্ধের নাম নারায়ণ চৌরাসিয়া। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত উঠতে দেখে গত বছরের মার্চে তাঁকে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন আত্মীয়েরা। সঙ্গে ছিল বৃদ্ধের ভুলে যাওয়ার সমস্যাও। এক সন্ধ্যায় নাকে রাইল্স টিউব, হাতে চ্যানেল, মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে হঠাৎ হাসপাতালের শয্যা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি। ভরা লকডাউনে সোজা উপস্থিত হন উত্তর কলকাতার এক পাড়ায়। এর পরেই তাঁকে ঘিরে শুরু হয় হুলস্থুল।
করোনা রোগী সন্দেহে বৃদ্ধকে ওই পাড়ার লোকজন তাড়া করেন বলে অভিযোগ। কোনও বাড়ি থেকে তাঁকে তাড়ানো হয় জল ছিটিয়ে, কেউ আবার বাঁশের ডগা দিয়ে ঠেলে দূরে সরান বৃদ্ধকে। এর পরে হাতে গ্লাভস পরে কয়েক জন ওই বৃদ্ধকে ধরে একটি বটগাছের নীচে বসান। কষে বাঁধা হয় তাঁর হাত-পা। নড়াচড়া করলেই উড়ে আসে চড়চাপড়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে এসে পুলিশও বৃদ্ধকে ছুঁতে চায়নি বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি। বৃদ্ধকে না নিয়েই ফিরে যায় পুলিশের অ্যাম্বুল্যান্স। তত ক্ষণে দড়ির চাপ আর বাঁশের ঘায়ে কালশিটে পড়ে গিয়েছে বৃদ্ধের গায়ে! ঘটনা দেখে এসে এক ব্যক্তি বৃদ্ধের পাড়ায় খবর দিতে ছুটে যান তাঁর আত্মীয়েরা।
সেই ঘটনার পরে এক বছর পেরিয়ে গিয়েছে। এখনও অবশ্য সে দিনের ভয়ই তাড়া করে ওই আত্মীয়দের। ভোটবঙ্গে নতুন করে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে দেখে সেই ভয়ই যেন আরও চেপে বসেছে তাঁদের।
বৃদ্ধের ভাগ্নে ধীরজ চৌরাসিয়া জানালেন, নারায়ণবাবুর স্ত্রী এবং তিন মেয়ের কেউই তাঁকে দেখতেন না। বৃদ্ধের ভরসা বলতে ছিলেন ধীরজ ও তাঁর পরিবার। সে দিন কোনও মতে মামাকে উদ্ধার করে এনে কয়েক দিন তাঁকে নিজের ঘরেই রাখা হয়েছিল। কিন্তু রোগ সারছে না দেখে ফের তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তবে দিন কয়েকের মধ্যেই হাসপাতাল থেকে আবার বেরিয়ে যান বৃদ্ধ। আর তাঁর খোঁজ মেলেনি। কোনও পাড়ায় ঢুকে পড়ায় একই পরিণতি হয়েছিল কি না, তা-ও আর জানা যায়নি।
ধীরজ বলেন, ‘‘লকডাউন না হলে হয়তো মামাকে হারাতে হত না আমাদের। করোনা পরিস্থিতি না হলেই তো আমাদের এক জনকে মামার সঙ্গে হাসপাতালে থাকতে দেওয়া হত। করোনা তো শুধু লাঞ্ছনা আর অপমান দেয়নি, এক জন অসুস্থ মানুষকে তাঁর পরিবারের থেকেও আলাদা করে দিয়েছে। ভোটের জন্যই আবার করোনা বাড়ছে। আবারও একটা লকডাউন হতে পারে মনে হলেই ভয়ে বুক কেঁপে যায়।’’
তা হলে কি ভোটদান থেকে বিরত থাকার কথাই ভাবছেন তাঁরা? স্বামীকে দেখিয়ে ধীরজের স্ত্রী গঙ্গা বললেন, ‘‘ও কী করবে জানি না, আমি ভোট দিতে যাবই। যাতে ফের করোনার বাড়বাড়ন্ত হলে অপমানিত না হওয়াটা নিশ্চিত করতে পারি।’’