প্রতীকী ছবি। ফাইল চিত্র
‘‘প্যাড তো ব্যবহার করতেই চাই। কিন্তু বাবা কিনে দিতে পারেন না। তুমি কি পারবে সেই জায়গাটা তৈরি করে দিতে?’’— পুরুলিয়ার ক্যাম্পে আসা মেয়েটির গলায় ছিল একরাশ আকুতি।
সুন্দরবনের কুলতলির কিশোরীর কণ্ঠে আক্ষেপ—‘‘তিন মাস হয়ে গেল প্যাড পাচ্ছি না। তাই কাপড়ই ভরসা।’’এ রাজ্যে মেয়েদের ঋতু-স্বাস্থ্য এবং স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের ছবিটা এমনই। আর্থিক অস্বচ্ছলতা, সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে কম দামে প্যাড বিলিতে অসামঞ্জস্য আর মা-ঠাকুরমার পুরনো অভ্যাস আঁকড়ে থাকার আগ্রহ— মূলত এই ত্রিফলায় আজও বিদ্ধ ঋতু-স্বাস্থ্য। তবু ভোটের মুখে কোনও রাজনৈতিক দলের কাছেই বিষয়টি পাত্তা পায় না। প্রচারে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইলেও ঋতু-স্বাস্থ্য নিয়ে কথা ‘কেহ তো বলে না’।
এ দেশে প্রায় ৩৫ কোটি ঋতুমতী মেয়ে এবং মহিলা থাকলেও অধিকাংশই ঋতুকালীন পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে পারেন না। দেশবাসীর একটি বড় অংশের কাছে ঋতুস্রাব আজও ‘অভিশাপ’, ‘নোংরা’, ‘অশুদ্ধ’। ২০১৫-’১৬ সালের ‘ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে’ অনুযায়ী, দেশের মোট ঋতুমতী মেয়েদের মাত্র ৩৬ শতাংশ ন্যাপকিন ব্যবহার করেন।
প্রায় একই ছবি এই রাজ্যেও। ২০১৩ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ৫৪১ জনের (১৩-১৮ বছর) উপরে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছিল, প্রথম বার ঋতুমতী হওয়ার আগে সেই সম্পর্কে ধারণা আছে মাত্র ৩৮ শতাংশের। আর সেখানকার গ্রামের ৫৫ শতাংশ মেয়ের কাছে ঋতুকালীন সময়ে কাপড়ই ভরসা। তবে ২০১৯-’২০ সালের তথ্য বলছে, এই সময়ে নিরাপদ জিনিস ব্যবহারকারীর সংখ্যা রাজ্যে কিছুটা বেড়েছে।
যদিও এই সংখ্যা বৃদ্ধিতে বিশেষ আশা দেখছেন না ‘কলকাতার প্যাডম্যান’, বাঁশদ্রোণীর শোভন মুখোপাধ্যায়। তিনি বলছেন, ‘‘আমপানের সময়ে বুঝেছিলাম, আপৎকালীন ওষুধের মধ্যে ন্যাপকিনকে ধরা হচ্ছে না। প্রত্যন্ত এলাকায় সে সময়ে প্যাড পৌঁছতেই পারেনি। ন্যাপকিনকে জিএসটির বাইরে রাখা হলেও লাভ হয়নি। কারণ প্যাডের দাম কমেনি।’’
কম দামে প্যাড দিতে ২০১৮ সালে রাজ্যে শুরু হয় ‘সাথী’ প্রকল্প। কিন্তু বাস্তব বলছে, অ-সম এবং অনিয়মিত বণ্টনের কারণে অধিকাংশ সময়েই সেই প্যাড রাজ্যের প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছয় না। যেমন, সুন্দরবনের কুলতলি ব্লকের ঋতুমতী মেয়েদের মাত্র ৬০ শতাংশের হাতে ওই ন্যাপকিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পৌঁছয়। বাকিদের ভরসা কাপড়।
ঋতুকালীন পরিচ্ছন্নতার অবস্থাও তথৈবচ। সুন্দরবনের একটি ব্লকের স্বাস্থ্য কাউন্সিলর জানাচ্ছেন, আমপানের পরে লবণাক্ত জলের পুকুরেই স্নান
করতে হয় মেয়েদের। রয়েছে জলের অভাবও। ফলে দুর্গন্ধযুক্ত অতিরিক্ত সাদা স্রাব, চুলকানি, সংক্রমণ, তলপেটে ব্যথা, চর্মরোগ-সহ নানা রোগে ভোগেন তাঁরা। আর চিকিৎসা? শোভন জানাচ্ছেন, কুলতলি ব্লকের শেষে বৈকুন্ঠপুর গ্রাম থেকে কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্র ২০ কিলোমিটার দূরে, যা আদতে কুকুর-বেড়ালের আস্তানা। নিকটবর্তী হাসপাতাল ৪০ কিলোমিটার দূরে, যেখানে কোনও স্ত্রী-রোগ
চিকিৎসকই নেই।
আমপানের পরে সুন্দরবনে স্বাস্থ্য শিবিরে যাওয়া, আর জি করের স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক নন্দিনী গোস্বামী জানাচ্ছেন, গ্রামের নিম্নবিত্ত মহিলাদের অধিকাংশই কাপড় ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ। অথচ সেই কাপড় রোদে শুকোতে দিতেও তাঁদের লজ্জা লাগে। ফলে পিআইডি (পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজ়িজ)-সহ একাধিক রোগ হওয়া খুব স্বাভাবিক। তাঁর কথায়, ‘‘ঋতুকালীন পরিচ্ছন্নতার অভাব আর পুকুরে স্নানের কারণে প্রায় ৫০ শতাংশ মহিলার মধ্যেই এই সব রোগের লক্ষণ দেখেছি। শহরের বহু বস্তিবাসী মহিলাও কাপড় ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ।’’
পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার জনজাতি ও আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের ছবি আরও ভয়াবহ। সেখানে আশাকর্মীরা মেয়েদের ন্যাপকিন দিলেও বাড়ির বড়রাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা ব্যবহারে বাধা দেন। স্কুলে কর্মশালা করেও তাই সাফল্য আসে না। ওই এলাকায় কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে দেবব্রত রায় বলছেন, ‘‘আদিবাসী এলাকায় ঋতুকালীন পরিচ্ছন্নতা শব্দটাই পৌঁছয়নি! বাঁকুড়া-পুরুলিয়া সীমান্ত এলাকায় কোলিয়ারি, ইস্পাত কারখানা বা ইটভাটার শ্রমিকদের মধ্যেও প্যাড ব্যবহারে অনীহা রয়েছে। ঋতু-স্বাস্থ্য সেখানে ভয়ঙ্কর ভাবে উপেক্ষিত।’’
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলিরও ঋতু-স্বাস্থ্যকে উপেক্ষার ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে’। সম্প্রতি স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের বিনামূল্যে প্যাড দেওয়ার ঘোষণা করেছে পঞ্জাব সরকার। অথচ এ রাজ্যে ভোটের আবহে এ নিয়ে কারও মুখে রা নেই! শোভন বলছেন, ‘‘বেটি বঁচাও, বেটি পড়াও বা কন্যাশ্রী-র মতো প্যাড সংক্রান্ত প্রকল্পকেও গুরুত্ব দিয়ে দেখলে তবেই কাজের কাজ হতে পারে। এর ঠিক রূপায়ণ হচ্ছে কি না, সেটাও দেখা দরকার। দলমত নির্বিশেষে নেতা-নেত্রীরা এ নিয়ে কথা বললে লড়াইয়ে আরও এক ধাপ এগোতাম।’’
রূঢ় বাস্তব হল, এ রাজ্যে ভোট-আবহে পিছনেই রয়ে যায় নারী-স্বাস্থ্যের প্রসঙ্গ। রাজনৈতিক আঙিনায় ঋতুকথা আজও ‘ব্রাত্য’।