মিঠুন চক্রবর্তী ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কয়েকবছর আগেও তাঁরা ছিলেন একই দলে সহকর্মী। তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যসভার সাংসদ করেছিলেন মিঠুন চক্রবর্তীকে। রাজ্য বিধানসভায় রাজ্যসভার সাংসদের পদে মনোনয়ন পেশ করে নবান্নে এসে বয়সে ছোট মমতার হাঁটু ছুঁয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন মিঠুন। সময় বয়ে গিয়েছে। সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তৃণমূলের সাংসদের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন মিঠুন। রাজনীতি থেকেই সন্ন্যাস নিয়েছিলেন তিনি। রবিবার সেই মিঠুনই ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে দাঁড়িয়ে গদগদ কণ্ঠে বললেন, এইদিনটা তাঁর কাছে এক স্বপ্নের দিনের মতো। কারণ, তিনি নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে একই মঞ্চে রয়েছেন। মিঠুনের ওই উচ্ছ্বাস প্কাশের কিছুক্ষণের মধ্যে শিলিগুড়িতে বক্তৃতা করতে উঠলেন মমতা। প্রত্যাশামতোই কড়া আক্রমণ করলেন মোদীকে। মোদীর ব্রিগেডকে। কিন্তু মিঠুন নিয়ে একটি শব্দও শোনা গেল না তাঁর মুখে।
ভদ্রতা? সৌজন্য? অভিমান? উপেক্ষা?
কারণ কী, তা কেউই জানেন না। কিন্তু প্রকাশ্য সভায় দেখা গেল, মমতা মিঠুন নিয়ে একটি কথাও বললেন না। ঘনিষ্ঠ বৃত্তে বলেছেন, রবিবার বিকেল পর্যন্ত তেমন খবর নেই। ব্রিগেডের সভায় মিঠুন নতুন স্লোগান দিয়েছেন, ‘‘এক ছোবলেই ছবি!’’ বলেছেন, তিনি ‘জাত গোখরো’। ছবির জনপ্রিয় ‘ডায়ালগ’ মনে করে ছাড় দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এ-ও ঘটনা যে, এমন ভাষায মিঠুনকে সাম্প্রতিক কালে প্রকাশ্যে বলতে শোনা যায়নি। তিনি বলেছেন, ‘‘আমি জলঢোড়াও নেই। বেলেবোড়াও নই। আমি হলাম জাত গোখরো!’’ রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মিঠুন বলেন, ‘‘আরও একটা স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম যে, আমি গরিবদের জন্য কিছু করব। আজ মনে হচ্ছে, কোথাও যেন সেই স্বপ্নটা দেখতে পাচ্ছি। এটা হবেই। কারণ স্বপ্ন শুধু দেখার জন্য নয়। তা সফল হওয়ার জন্যই আসে। কেউ যদি হৃদয় দিয়ে দেখতে স্বপ্ন সফল হবেই।’’ নিজেকে ‘গর্বিত বাঙালি’ হিসাবে তুলে ধরে তাঁর মন্তব্য, ‘‘দেশবন্ধু চিত্তররঞ্জন, রানি রাসমণি আসলে বাঙালি। যারা মানুষের হক কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে, সেখানে আমাদের মতো কিছু লোক বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে।’’ সূত্রের খবর, মিঠুন বাংলার বিধানসভা ভোটে বিজেপি-র হয়ে সক্রিয় ভাবে প্চার করবেন। মিছিল এবং জনসভাও করবেন। তবে তিনি সম্ভবত ভোটে দাঁড়াবেন না।
মিঠুনের বক্তব্য শুনে তাঁকে একদিকে যেমন অভিভূত এবং আপ্লুত মনে হয়েছে, তেমনই মনে হয়েছে, অনতি-অতীতের রাজনীতির তিতকুটে স্বাদও তাঁর মুখে এখনও লেগে রয়েছে। যা তিনি পিছনে ছেড়ে আসতে চেয়েছেন। এটা ঘটনা যে, মিঠুনও তাঁর পুরনো দল বা নেত্রী সম্পর্কে একটি শব্দও বলেননি। সেটা সম্ভবত তাঁরও ব্যক্তিগত সৌজন্য। কিন্তু যিনি রাজনীতিতে থাকবেনই না ভেবেছিলেন, তিনি যে ভাবে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন এবং আপ্লুতি দেখিয়েছেন (সেটা খুব অস্বাভাবিক নয়। কারণ, তাঁকে ‘যুবহৃদয় সম্রাট’ বলে অভিহিত করেছএন বিজেপি-র প্রথমসারির নেতা শমীক ভট্টাচার্য। আর তাঁকে বিশ্বজনীন ‘দাদা’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন সাংসদ অর্জুন সিংহ), তা তাঁর প্রাক্তন সহকর্মীদের নজর এড়িয়ে না গিয়ে পারে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও মমতা-সহ কেউই কিছু প্রকাশ্যে বলেননি। এমনিতে মমতা তাঁর দলের ‘তারকা’ রাজনীতিকদের ‘অতিথি’ হিসাবেই দেখেন। অতীতেও তাঁকে একাধিকবার বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘ওঁরা আমাদের অতিথি। ওঁরা অন্যান্য সৃষ্টিশীল কাজ করেন। ওঁরা আমাদের দলে এসেছেন। আমরা কৃতজ্ঞ।’’ এবং পাশাপাশি এটাও ঠিক যে, তাঁদের কেউ দল ছেড়ে চলে গেলেও মমতা তাঁদের বিরুদ্ধে কখনও কোনও বিরূপ মন্তব্য করেননি। কিন্তু কোনও পেশাদার রাজনীতিক তৃণমূল ছেড়ে চলে গেলে মমতা চাঁছাছোলা ভাষায় তাঁদের আক্রমণ করেছেন। যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হলেন শুভেন্দু অধিকারী এবং রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতার ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, সেই ‘সৌজন্যবোধ’ থেকেই মমতা মিঠুনকে নিয়েও প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করেননি। তাঁর দলের নেতারা অবশ্য ইতিহাস মনে করিয়ে দিতে চেযে মিঠুনকে প্রকারান্তরে ‘অকৃতজ্ঞ’ বলতে চেয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, রাজ্যসভার সাংসদ হওয়ার পর মিঠুন বলেছিলেন, ছোটবোন মমতার দেওয়া ওই সম্মান তিনি কোনওদিন ভুলবেন না। মমতার প্রতি তিনি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবেন। মিঠুনের বিজেপি-যোগের জল্পনার সমান্তরালেই বলিউড সুপারস্টারের উপর প্রকারান্তরে সেই ‘চাপ’ তৈরি করা শুরু হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল, মিঠুন সে সবের তোয়াক্কা করেননি।