দাপট। ডাবগ্রাম-ফুলবাড়িতে তৃণমূলের পতাকা নিয়ে মোটরবাইক মিছিল। শুক্রবার বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।
জোট বার্তা জোরদার করতে বাম-কংগ্রেস নেতা-কর্মীরা পথে নামতেই হামলা, হুমকির অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে শাসক দল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। জোটের মিছিলের গা ঘেঁষে বেআইনি বাইক মিছিল নিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে শিলিগুড়ি লাগোয়া ফুলবাড়িতে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের বিধানসভা কেন্দ্রে পুলিশ-কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহলের তোয়াক্কা না করে বাইক নিয়ে মিছিল করে গাঁ-গঞ্জে কংগ্রেস-সিপিএমের লোকজনকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠছে মন্ত্রীর দলের বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই জলপাইগুড়ির ময়নাগুড়ি থেকে আলিপুরদুয়ার বিভিন্ন এলাকায় বাম এবং কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকদের উপরেও হামলার অভিযোগ উঠেছে। সব ক্ষেত্রেই অভিযোগের তির তৃণমূলের দিকে। বিরোধীদের অভিযোগ, গত পাঁচ বছরে পুলিশের একাংশ অফিসার শাসকের দলদাসে পরিণত হয়েছেন। তাঁদের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঠুঁটো করে হামলা, হুমকির রাজত্ব কায়েম করতে চাইছে তৃণমূল। তৃণমূলের তরফে গৌতমবাবু সব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন।
লাঠিপেটা
ময়নাগুড়ির দক্ষিণ খাগরাবাড়ির দাসপাড়ার বাসিন্দা মাছ ব্যবসায়ী মহাদেব দাস দীর্ঘ দিন ধরেই সিপিএম কর্মী বলে পরিচিত। বিরোধী জোটের প্রার্থীর দেওয়াল আঁকা থেকে বাড়ি-বাড়ি প্রচার, সবেতেই মহাদেববাবুকে প্রথম সারিতে দেখা যাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার বাড়ির পাশেই একটি এলাকায় দোল উপলক্ষে তাঁকে নিমন্ত্রণ করেন কয়েকজন তৃণমূলকর্মী। অভিযোগ, বামেদের হয়ে প্রচারে না যেতে হুমকি দেওয়া হয় মহাদেববাবুকে। প্রতিবাদ করায় বাঁশ দিয়ে মহাদেববাবুকে পেটানো শুরু হয় বলে অভিযোগ। মহাদেববাবুর মাথা ফেটে যায়, জখম হয় দুই চোখও। রক্তাক্ত অবস্থায় মহাদেববাবু বাড়ি ফিরে এলে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছু পরে অভিযুক্ত তৃণমূলকর্মীরা মহাদেববাবুর বাড়িতে চড়াও হয় বলে অভিযোগ। মহাদেববাবুকে না পেয়ে তাঁর দুই মেয়েকে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ, ভেঙে দেওয়া হয় ঘরের দরমার বেড়াও।
বাড়িতে ঢিল
রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ বাড়ির চালে, দেওয়ালে ঢিল আছড়ে পড়ার বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আলিপুরদুয়ার কোর্ট রেল লাইন লাগোয়া এলাকার বাসিন্দা শিক্ষক নেতা জয়ন্ত সাহার। টানা দু’ঘণ্টা তাঁর বাড়ির সামনে কয়েক জন যুবক তাণ্ডব চালায় বলে অভিযোগ। কখনও ঢিল ছোড়ে কখনও ফাঁকা মদের বোতল দেওয়ালে ছুড়ে মারা হয় বলে অভিযোগ। পড়শিদের অভিযোগ, মাঝেমধ্যে যুবকদের মুখে ‘মা-মাটি মানুষ জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগানও শোনা যায়। ঘটনা হল, গত বৃহস্পতিবার দুপুরেই আলিপুরদুয়ার জংশনে সিপিএমের পার্টি অফিসে কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথ বৈঠকের অন্যতম আয়োজক ছিলেন শিক্ষক নেতা জয়ন্তবাবু। দুপুরের বৈঠকে স্থির হয়, আরএসপি নয়, সিপিএম সমর্থন করবে আলিপুরদুয়ারের জোট প্রার্থী কংগ্রেসের বিশ্বরঞ্জন সরকারকেই। ঠিক হয়, দু’দলের নেতারাই এ দিন শুক্রবারে মিছিলে হাঁটবেন। আলিপুরদুয়ারে এই জোটের অন্যতম উদ্যোক্তা জয়ন্তবাবুর বাড়িতে পরিকল্পনা করেই হামলা চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ বাম-কংগ্রেসের। বিশ্বরঞ্জনবাবুর অভিযোগ, ‘‘জোটের হয়ে বাম এবং কংগ্রেসের সর্ব স্তরের নেতা-কর্মীরা পথে নামাতেই তৃণমূলের হৃৎকম্প শুরু হয়েছে। তাই হামলা চালাচ্ছে।’’ যদিও, তৃণমূলের অভিযোগ, হামলাকারীরা তাদের দলের কেউ নয়, জয়ন্তবাবুর প্রাক্তন ছাত্র।
বাইক মিছিল
শুক্রবার সকালে নিজের কেন্দ্র ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি এলাকায় প্রচারে বেড়িয়ে শাসকদলের চোখ রাঙানি দেখতে হয় বিরোধী জোটের সিপিএম প্রার্থী তথা শিলিগুড়ি পুরসভার চেয়ারম্যান দিলীপ সিংহকে। এমনই অভিযোগে কমিশনের কাছে নালিশ জানিয়েছেন দিলীপবাবু। শিলিগুড়ি লাগোয়া ফুলবাড়ি এলাকায় শতাধিক কর্মী সমর্থক নিয়ে হেঁটে প্রচার করছিলেন দিলীপবাবু। মিছিলে কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকরাও ছিলেন। সে সময় ২০-২৫টি বাইকে করে তৃণমূলের বাহিনী তাঁদের অনুসরণ করে বলে অভিযোগ। মিছিলে হাঁটা কর্মী-সমর্থকদের বাইক আরোহীরা বাড়ি ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে হুমকি দেয় বলে অভিযোগ। কমিশনের নির্দেশ ভেঙে বাইক মিছিল হলেও, কোনও পদক্ষেপ হয়নি বলে অভিযোগ। দিলীপবাবুর প্রশ্ন, ‘‘আমাদের সমর্থকদের হুমকি দিতেই বাইকবাহিনী ঘুরছে। এক দলের মিছিলেরপাশে অন্য দলের বাইক বাহিনী ঘুরছে এমন হয়?’’ দিলীপবাবুর দাবি, কমিশনকে জানানো হয়েছে। বাহিনীকেও অভিযোগ জানানো হবে।
বোমায় জখম
শুক্রবার ইটাহারের গুলন্দর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের পারের গ্রাম এলাকায় বোমা ফেটে এক তৃণমূলকর্মী জখম হন। তাঁর দাবি, রাস্তার পাশে ঝোপের আড়ালে বোমা রাখা ছিল, তাতে পায়ের চাপ পড়াতেই বিস্ফোরণ হয়। যদিও, কংগ্রেস এবং বামেদের অভিযোগ, ভোটের আগে বিরোধীদের উপর হামলা চালিয়ে তাঁদের এলাকা ছাড়া করতে তৃণমূল বোমা মজুত করার কাজ করছিল। মজুত করতে গিয়েই একটি বোমা ফেটে ওই তৃণমূলকর্মী জখম হন বলে অভিযোগ। পরে ঘটনাস্থল থেকে আরও একটি বোমা উদ্ধার করে পুলিশ।
এ কেমন পুলিশ
ময়নাগুড়ির আক্রান্ত সিপিএম কর্মী মহাদেব দাসের পরিবারের সদস্যরা গত বৃহস্পতিবার রাতেই ময়নাগুড়ি থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত তো দূরের কথা, পরিবারের সদস্যদের অভিযোগের প্রতিলিপিও ময়নাগুড়ি থানা থেকে দেওয়া হয়নি। রাতভর অভিযুক্তরা এলাকায় দাপিয়ে বেড়িয়েছে বলে দাবি খাগরাবাড়ির দাসপাড়ার বাসিন্দাদের। শুক্রবার সকালে বামেদের তরফে জেলা পুলিশ সুপারকে ঘটনাটি জানানো হয়। কমিশনের কোপে পড়ার আশঙ্কায় নড়েচড়ে বসে পুলিশ। ময়নাগুড়ি থানায় ফোন আসে জেলা পুলিশ সুপারের দফতর থেকে। তারপরেই দ্রুত অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করা হয়। প্রায় ২০ ঘণ্টা পরে মহাদেববাবুর বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশ। জলপাইগুড়ি জেলা পুলিশ সুপার আকাশ মেঘারিয়া বলেন, ‘‘মামলা দায়ের হয়েছে। তদন্ত চলছে।’’ আলিপুরদুয়ারে শিক্ষকনেতার বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ দায়ের হলেও, অভিযুক্তরা অধরাই রয়েছে বলে দাবি। এলাকাতেই অভিযুক্তরা দাপটে ঘুরছে বলে অভিযোগ।
বিরোধীদের অভিযোগ
বাম-কংগ্রেসের অভিযোগ, স্থানীয় পুলিশ অফিসারদের একাংশকে দলদাসে পরিণত করে ভোটের মুখে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে তৃণমূল। সিপিএমের ময়নাগুড়ির জোনাল সম্পাদক অরুণ ঘোষের অভিযোগ, ‘‘ময়নাগুড়ি থানার আইসি তৃণমূলের একজন প্রভাবশালী নেতা। সে কারণেই দু’বছরের বেশি সময় ধরে থাকলেও, তার বদলি হয় না। সিপিএম কর্মী মার খেয়ে অভিযোগ জানালেও, তাই ময়নাগুড়ি থানা প্রথমে মামলা শুরু করে না, এমনকী অভিয়োগের প্রতিলিপিও দেয় না। সব কিছুই কমিশনের নজরে আনব।’’ আলিপুরদুয়ারে কংগ্রেস প্রার্থী বিশ্বরঞ্জনবাবুরও একই সুরে অভিযোগ, ‘‘আইসি তো সরাসরি তৃণমূল করেন। তাঁর বিরুদ্ধে পক্ষপাতের ভুরিভুরি অভিযোগ রয়েছে। কমিশনকে আগেও জানিয়েছি। আবার জানাব।’’