অকেজো গুড়-জল, কেষ্টর জোশ যেন ফিকে

ঢাক বেজেছিল। রবি ঠাকুরের গানের ব্যবস্থা হয়েছিল। গুড়-জলও ছিল। কিন্তু রবিবারের বীরভূম দেখল ওস্তাদ অনুব্রত মণ্ডলের তাল যেন কোথাও কেটে গিয়েছে।

Advertisement

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

বোলপুর শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৬ ০৫:০৮
Share:

বোলপুর দুপুরের খাওয়া সারছেন অনুব্রত মণ্ডল। রবিবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

ঢাক বেজেছিল। রবি ঠাকুরের গানের ব্যবস্থা হয়েছিল। গুড়-জলও ছিল। কিন্তু রবিবারের বীরভূম দেখল ওস্তাদ অনুব্রত মণ্ডলের তাল যেন কোথাও কেটে গিয়েছে।

Advertisement

প্রায় তিন হাজার বুথে ভোটের পর বীরভূমে চড়াম চড়াম আওয়াজ হয়নি। গুড়-জলের স্টকও কাজে লাগেনি। প্রবল গরম উপেক্ষা করে ভোটাররা ইভিএমে পোঁ পোঁ আওয়াজ তুলেছেন। অনুব্রত মুখে ভাঙছেন না অবশ্য। এ দিনও বললেন, ‘‘কাল ছিল বাসন্তী পুজোর দশমী। বিসর্জন হয়েছে। ঢাকও বেজেছে।’’ কিন্তু কাজ হয়েছে কি? জবাব এল, ‘‘বয়সের কোনও শেষ নাই, মারের কোনও বয়স নাই। এটা যেন মনে থাকে।’’ আশানুরূপ ফল হবে না বুঝেই কি এমন নির্বিচার প্রহারের হুঙ্কার?

এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না লালমাটির খাসতালুকে। কিন্তু তা-ই হল। সকালে দুধ-সাদা পাঞ্জাবি পরে মেয়েকে নিয়ে ভোট দিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগবত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে ভোট দিয়েই বিতর্কে জড়ালেন। সাদা পাঞ্জাবিতে জোড়া ফুলের প্রতীক লাগানো যে! দিনভর বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ভুল স্বীকার করলেন। তাতেও মন গলল না নির্বাচন কমিশনের। ভোট শেষে তাঁর নামে এফআইআর দায়ের করলেন বোলপুরের রিটার্নিং অফিসার।

Advertisement

‘অভিযুক্ত’ অনুব্রত ভোটবেলাটা কাটালেন নিচুপট্টির দলীয় দফতরেই। কিন্তু চিরাচরিত বাজখাঁই গলাটা কখনও কখনও যেন ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছিল। হওয়ারই কথা। কারণ, তাঁর দশ আনন যখন কুরু‌ক্ষেত্র থেকে খবর পাঠাতে শুরু করলেন, সেগুলো ঠিক সুখবর ছিল না। বারবারই শোনা যাচ্ছিল, কেন্দ্রীয় বাহিনী বড্ড বাড়াবাড়ি করছে। কোথাও কোথাও রাজ্য পুলিশের আচরণও কেমন যেন অচেনা। শুনে কেষ্টদার স্বগতোক্তি, ‘‘সেন্ট্রাল ফোর্সে ছেয়ে দিয়েছে আজ। তবুও ১১টাই জিতব।’’

এর পরই লাগাতার হুকুম। ‘‘ধর জটিলকে। দেখি ময়ূরেশ্বরটা।’’ জটিল জানালেন, বুথে শুধু নয় গ্রামেও তাড়া করছে।

এ বার এলেন সাবের। জানা গেল, চার দিকে ‌শুধু প্রেস। কাজ হচ্ছে না। দাদার সামনে বসে থাকা জনা তিরিশ সাংবাদিকের প্রতি লাল চোখের নজর ঘুরিয়ে নির্দেশ গেল, ‘‘প্রেস থাক। ওরা ওদের কাজ করবে। তোমাদের কাজ তোমরা করবে।’’

কাজ কিন্তু কথা মতো হচ্ছিল না। ফোনে এলেন ইলামবাজারের জাফারুল। কেষ্টদা জানতে চাইলেন, ‘‘বাবা জাফার সব ওকে তো?’’ কী উত্তর এল জানা নেই। তবে ১১০ কিলোগ্রামের শরীরটা কঠিন মুখে বলে উঠল, ‘‘করতে হবে। আরও করতে হবে। দেখে নাও।’’ ফোন গেল মনিদার (মনিরুল ইসলাম) কাছেও। তখন দুপুর দু’টো হবে। অনুব্রত বললেন, ‘‘আর কখন করবেন? চালু করে দিন!’’

যেমন কথা তেমন কাজ। কিছুক্ষণের মধ্যেই টিভিতে ব্রেকিং নিউজ। লাভপুরের সাউগ্রামে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে আক্রমণ করেছে তৃণমূলের বাহিনী। তাঁদের দাবি, মহিলাদের ভোট পুরুষরা দেবে। টিভির পর্দায় চোখ রেখে কেষ্টদা ঘনিষ্ঠ সাংবাদিককে চোখ মারলেন। এক হাতের পাঞ্জা তুলে দেখালেন, পঞ্চাশ হবে।

কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে স‌ঙ্গে ফের স্পষ্ট হল, যেমনটা চেয়েছিলেন তেমন হচ্ছে না। এক স্থানীয় নেতা ফোন করে অভিযোগ করলেন, ইলামবাজার থানা জনা কয়েক কর্মীকে ধরে ছাড়ছে না। কেষ্টদা ধরলেন পুলিশের এক কর্তাকে। সঙ্গে সঙ্গে কড়া ধমক, ‘‘কী হচ্ছেটা কী? ছেড়ে দিন ওদের।’’ উত্তরে ইতিবাচক কিছু শুনলেন বলে মনে হল না।

অনুব্রত তবু নাছোড়। হবেন নাই বা কেন? তাঁর জন্য নির্বাচন কমিশন আট জন সিআরপি জওয়ান মোতায়েন করেছে। রয়েছেন এক জন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটও। তবু ভোটের আগের রাতে তিনি লুকিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন নিজেই। চোখ এত লাল কেন? বুঝিয়ে বললেন, ‘‘ভাইটি, ঘুম হয় নাই। কাল রাত তিনটেয় বাড়ি ঢুকেছি।’’ সে কী, আপনার তো বোলপুর ছা়ড়া নিষেধ ছিল! তাচ্ছিল্যের জবাবে জানা গেল, শনিবার রাত ১০টা নাগাদ বাড়ির পি‌ছনের দরজা দিয়ে মোটরবাইকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী আর গাড়ি। কোথায় গেলেন? কেষ্টদা জানালেন, সকালে খয়রাশোল যাওয়া হয়নি। ওখানকার অবস্থা ভাল ছিল না। মেরামত করতে রাতেই যেতে হয়। নানুরের থুপসরাতেও কিছু কাজ ছিল। সে সব মিটিয়ে রাতে ফেরেন। ‘‘সদরে তখন কমিশন-এজেন্টরা। তাই খিড়কি দরজা দিয়েই ঢুকলাম,’’ অকপটে জানালেন।

কিন্তু রাতের অন্ধকারে চোখে ধুলো দিলেও ‘কমিশন-এজেন্টরা’ যে অনুব্রত মণ্ডলকে ভোটের সকালে বেশ চাপেই রাখলেন, দিনভর তা টের পাওয়া গেল। বারে বারেই তাঁকে বলতে শোনা গেল, ‘‘পার্সেন্টেজ এত কম কেন? নব্বইয়ে নিয়ে যেতে হবে।’’

এমন সময়ে দাদার সঙ্গে দেখা করতে এলেন পাড়ার বুথের এক কর্মী। কী রে কত হল? উৎসাহী যুবকের উত্তর, ‘‘৮৫% করে দিয়েছি। ভোট শেষ।’’ দাদা জানতে চাইলেন, ভোটার আর নেই? ক্যাডার জানালেন, ‘‘না।’’ ক্ষিপ্ত দাদার ধমক, ‘‘ভোটার নাই তো কী হয়েছে, তোমার আঙুল তো আছে! যাও ৯০% করে এস।’’ বেরিয়ে গেলেন আগন্তুক। শেষ পর্ষন্ত অবশ্য জানা গেল না, আঙুল নির্দেশ মতো কাজ করল কি না।

হাঁটু বদলিয়ে বৌদি আজই ফিরেছেন বেঙ্গালুরু থেকে। কুশল জেনেই বৌদির সহকারীকে দাদার নির্দেশ, ‘‘জানি তোর কষ্ট হয়েছে। কিন্তু ভোটটা করাতে হবে। দু’টি খেয়ে বুথে চলে যা।’’

অনুব্রত আজ কোনও ‘চান্স’ নিতে রাজি নন। একটি বুথেও নয়। এত চাপ কেন? অনুব্রতের জবাব, ‘‘চাপ নয়। চেষ্টা। ১১-০ করবই।’’

হাসলেন সিপিএম প্রার্থী রামচন্দ্র ডোম। পারবেন দশাননকে হারাতে? জবাব ইঙ্গিতবাহী, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী সক্রিয় ছিল, মানুষ ভোট দিয়েছে।’’

আরও পড়ুন...

দুরন্ত ফিল্ডিংয়ে আটকাল রান, সজাগ আম্পায়ারও

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement