রমাপ্রসাদ মণ্ডল (প্রিসাইডিং অফিসার)
শিক্ষকতার জীবনে ভোটের ডিউটি— অনেকে একটু ভয় ভয় পান। তবে আমি ডরায় না মোটেই। ভোটের চিঠি এলে বরং মনটা আনন্দে ভরে যায়। এ বার আমার ভাগ্য বেশ ভালই বলতে হবে। জেলায় ভোটের দু’টো পর্বেই আমার ডিউটি পড়েছে।
প্রথম পর্ব অর্থাৎ ১১ এপ্রিল শিল্পাঞ্চলের ভোটে আমাকে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব সামলাতে যেতে হয়েছিল দুর্গাপুরে ন’ডিহা-বীরভানপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অল্পবিস্তর ঝক্কি পেরিয়ে ডিসিআরসি যাওয়া, সেখান থেকে আবার বাসে করে ভোটকেন্দ্র। তবে ভোটকেন্দ্রে পৌঁছতেই যাত্রাপথের সমস্ত ক্লান্তি এক নিমেষে উবে গেল। ভোটকেন্দ্র আলো, পাখা, পানীয় জলের সুবন্দোবস্ত রয়েছে। চায়ে চুমুক দিয়েই কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের সঙ্গে খানিক আড্ডা দিলাম। ভোটের সমস্ত কাগজপত্র দেখে নেওয়ার কাজ শুরু হল। রাতে খাওয়া-দাওয়া যথাসময়ে সেরে ফেললাম। কিন্তু তারপরেই ছন্দপতন। জল নেই। সেক্টর অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হল। ভোরবেলা ঘুম ভেঙে দেখি তখনও জল আসেনি। তবে কিছুক্ষণ বাদেই পুরসভার জলের গাড়ি ভোটকেন্দ্রে চলে এল।
ঠিক সময়ে ভোট শুরু হল। কিন্তু ফের সমস্যা জল নিয়ে। জল রয়েছে, কিন্তু এত গরম যে খাওয়া তো দূরঅস্ত, হাতই দেওয়া যাচ্ছে না। ফের দ্বারস্থ হলাম সেক্টর অফিসারের।
আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করে প্রশাসনের প্রতিনিধিরা ২৫০ মিলিলিটারের জলের পাউচ দিয়ে গেলেন। কিন্তু সে জলও এত গরম, গলায় ঢালা যায় না। এমন সময় লক্ষ করি লাইনে দাঁড়ানো এক মহিলা ভোটারের হাতে ঠান্ডা জলের বোতল রয়েছে। মহিলার স্বামী জানতে চাইলেন আরও জল লাগবে কিনা? খানিক বাদেই দেখি তিনি ২ লিটারের দু’টি বোতল হাতে দাঁড়িয়ে। কিন্তু জওয়ানরা তাঁকে ঢুকতে দিচ্ছেন না। অগত্যা আমাকেই এগিয়ে যেতে হল।
ভোট শেষ করে সবকিছু জমা দিয়ে ফেরার পথে আবার বিপত্তি। আমার বাড়ি গুসকরায়। কিন্তু গুসকরা যাওয়ার কোনও বাস নেই। শেষ পর্যন্ত আমার হাল দেখে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক আধিকারির একটা বাসের বন্দোবস্ত করলেন। তবে বাস ছাড়বে রাত দেড়টা নাগাদ। গভীর রাতে বাস ছাড়ল বটে, কিন্তু যাত্রী বলতে আমি একা।
প্রথম পর্বের ভোটের রেশ মিটতে না মিটতেই চলে এল ২১ এপ্রিল। ফের যেতে হবে। এ বার গন্তব্য রায়নার বেলার-ভূরখুণ্ডা উচ্চ বিদ্যালয়। রোদ-গরমের মধ্যে ডিসিআরসি যেতে একটু কষ্টই হল। তার উপর আবার মেঠো পথ। বাস প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। তবে মন ভরিয়ে দিল ভোটকেন্দ্রের চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ভোটকেন্দ্রে পৌঁছতেই এক কিশোর এগিয়ে এল। ‘কী নাম তোমার?’ জিজ্ঞেস করতেই তার চটজলদি জবাব, ‘আমি চাবিবাবু।’ বুঝতে পারলাম স্কুলের ক্লাসঘর, গেটে তালা দেওয়ার দায়িত্ব তার। মাঝখানে মিড ডে মিলের রাঁধুনীরা কিছু খাবার দিয়ে গেলেন। বাহিনীর জওয়ানরা বাঁজখাই গলায় আশ্বাস দিলেন, ‘নিশ্চিন্তে থাকুন। আমরা আছি।’ আশ্বস্ত থেকেও রাতে ঘুমটা অবশ্য মোটেই হল না। কারণ স্কুলবাড়ির চারপাশে রাতভর ডেকে চলল শেয়ালের দল।
ভোট শুরু হল সকাল সকাল। খানিক বাদে দেখি এক প্রৌঢ়া ইভিএম মেশিনের বোতামটা কী ভাবে টিপতে হবে, কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। নকল ইভিএম মেশিন নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে বোঝানোর পর্ব চলল ওই মহিলাকে। কিন্তু বোঝানোই সার। ভোট দিতে যাওয়ার সময় দেখি উনি ভোটকক্ষে থাকা ইলেকট্রিক বোর্ডের স্যুইচ টিপে ফেললেন। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার বিরতিতে এক জওয়ান আবার ফোনে ওনার হবু স্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলিয়েই ছাড়লেন। কারণ ওই জওয়ানের হবু স্ত্রী’টিও নাকি স্কুল শিক্ষক।
সব মিলিয়ে ভীষণ হইহই করে কাটল দেলায় ভোটের দু’টো পর্বই। জল এগিয়ে দেওয়া মহিলা, তাঁর স্বামী, ‘চাবিবাবু’, প্রৌঢ়া আর ওই জওয়ান— কাওকেই যে ভোলার নয়।
(লেখক বনসুজাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক)