চিঠিতে এই সম্বোধন নিয়েই বিতর্ক।
কাজ সেরে কর্তা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেই গনগনে চোখে গিন্নির প্রশ্ন— ‘‘হ্যাঁ গো, পার্টি করা শুরু করেছো না কি?’’ হকচকিয়ে যান কর্তা! তাঁর হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দেন গিন্নি। চিঠি খুলেই আঁতকে উঠলেন বড়জোড়ার বাসিন্দা বেসরকারি সংস্থার ওই কর্মী। অবাক গলায় বলে উঠলেন, “যা...বাবা! আমি আবার কবে ‘কমরেড’ হয়ে গেলাম!’’ পরে পাড়ায় বেরিয়ে পড়শিদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলেন শুধু তিনি একাই নন, আশপাশের অনেকেই ভোট-বাজারে রীতিমতো ‘কমরেড’ হয়ে গিয়েছেন!
বিস্ময়ের কারণ আসলে আপাত-নিরীহ একটি চিঠি! ভোটের বাজারে সাধারণ নাগরিকদের ভোটের বৈঠকে
আমন্ত্রণ জানাচ্ছে সিপিএম। চিঠিতে অভ্যাসবশত সকলের নামের আগেই বসে যাচ্ছে ‘কমরেড’! ঘাবড়ে যাচ্ছেন অনেকে! কেউ কেউ মজাও পাচ্ছেন!
ছুঁৎমার্গ ঝেড়ে ফেলে কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে ভোটে লড়তে নেমে বাম নেতারা এ বার ‘মানুষের জোট’ গড়ার কথা বলছেন। তাই যথাসম্ভব পাশে টানতে চাইছেন সাধারণ মানুষকে। সেই ভাবনা থেকেই বাঁকুড়ার বড়জোড়ায় সিপিএমের কিছু নেতা-কর্মী ছাপানো চিঠি পাঠিয়ে তাঁদের বৈঠকে আসার জন্য আম জনতাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। সেই চিঠিতেই রাজনীতি থেকে শত হস্ত দূরে থাকা অনেক হরিপদ কেরানির নামের গোড়াতেও ‘কমরেড’ শব্দ জুড়ে দেওয়া হচ্ছে!
বাংলার রাজনীতি এত দিন বুঝে এসেছে, ‘কমরেড’ মানেই বাম। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, ৩৪
বছরের শাসনেক কৃপায় কমরেড মানেই সিপিএম! নাগরিক চিঠিতে ‘কমরেড’ পেয়ে বিস্ময়ের ঘোরও সেই জন্যই! কিন্তু সত্যিই কি ‘কমরেড’ মানে শুধু সিপিএম?
সিপিএমের অনেক নেতাই জানাচ্ছেন, কমরেড অর্থে বন্ধু বা সহযোদ্ধা বোঝায়। তাই যাঁকে লড়াইয়ে পাশে পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে, তাঁকে কমরেড বলে সম্বোধন করা যেতেই পারে। দীর্ঘ দিনের পোড় খাওয়া বাম নেতারা জানাচ্ছেন, দলে জনসংযোগের এই পদ্ধতিও বেশ পুরনো। বহু আগে ব্যাপক ভাবে এর প্রচলন ছিল। তবে বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে এই সংস্কৃতিতে ভাটা পড়ে। বহু অঞ্চলে চিঠি পাঠিয়ে সাধারণ মানুষকে সভায় আমন্ত্রণ জানানোর পদ্ধতি প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে ফের সেই পুরনো পত্র প্রেরণ পন্থাকেই জনসংযোগ বাড়ানোর অন্যতম হাতিয়ার করেছে বামফ্রন্ট। আর সেখানে অনভ্যাসের ‘কমরেড’ পড়ে খটকা লাগছে অনেকের!
সিপিএমের বাঁকুড়া জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা বাঁকুড়া
জোনাল সম্পাদক প্রতীপ মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলছেন, “এখন সাধারণত দলের তরফে সাধারণ মানুষকে চিঠি
করা হলে সুধী, মহাশয়, মহাশয়াই লেখা হয়। শেষে লেখা হয় নমস্কারান্তে।’’ চিঠি যদিও ‘কমরেড’ই বলেছে।
ঘটনা হল, ভোট, জোট এবং দলবদলের বাজারে কমরেড সম্ভাষণের বাজারও বাড়ছে! পশ্চিম মেদিনীপুরের সবংয়ে যেমন প্রচার-সভায় কংগ্রেস প্রার্থী মানস ভুঁইয়াকে কমরেড বলেই উল্লেখ করেছেন স্থানীয় সিপিএমের নেতা-কর্মীরা। অনভ্যস্ত হলেও মানসবাবু অবশ্য চমকে যাননি। তাঁর কথায়, ‘‘কমরেড মানে তো বন্ধু, সাথী। একসঙ্গে লড়তে নেমেছি যখন, এটা বলতে অসুবিধা কী আছে?’’ আবার সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে গেলেও আব্দুর রেজ্জাক মোল্লাকে ছাড়েনি ‘কমরেড’! ভাঙড়ের দেওয়াল তার সাক্ষী। দলের প্রার্থীর নামের আগে ‘কমরেড’ দেখে এলাকার কিছু তৃণমূল কর্মী অসন্তুষ্ট ঠিকই। তবে রেজ্জাক কমরেড শব্দের মানে উল্লেখ করে জানাচ্ছেন, তৃণমূলে থেকেও ওই সম্বোধনে তিনি ভুল কিছু দেখছেন না। কানহাইয়া-কাণ্ডে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় হোক বা ‘হোক কলরবে’র যাদবপুর— বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিবাদী পড়ুয়ারা কমরেড হয়ে উঠেছেন অচিরেই।
সিপিএমের নেতা-কর্মীরা তাই বলছেন, এখন রাজ্য জুড়ে তৃণমূল সরকারকে সরাতে সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের এক হওয়া দরকার। এই যুদ্ধে সহযোদ্ধা পেতে কমরেড ডাকে কীসের আপত্তি!
বাঁকুড়া জেলায় যেমন প্রতিটি অঞ্চলে অঞ্চলে কট্টর তৃণমূল কর্মী ছাড়া অন্য সাধারণ মানুষের বাড়িতে গিয়ে চিঠি দিয়ে নাগরিক সভায় আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন সিপিএম কর্মীরা। বড়জোড়ার সিপিএম নেতা তথা দলের জেলা কমিটির সদস্য সুজয় চৌধুরীর দাবি, “গত কয়েক সপ্তাহে বড়জোড়ায় ২৩-২৪টি নাগরিক সভা হয়েছে। সভায় এমন বহু মানুষ এসেছিলেন, যাঁরা গত কয়েকটি নির্বাচনে তৃণমূলের হয়ে মিছিলেও পা মিলিয়ে ছিলেন।’’ বড়জোড়ার পত্রপ্রাপকদেরও কারও কারও মত, “দীর্ঘ বাম আমলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল সিপিএম নেতা-নেত্রীদের। তবে বাড়িতে আমন্ত্রণপত্র পাঠানোয় মনে হচ্ছে তাঁরা নিজেদের খানিকটা পাল্টেছেন।” কেউ কেউ আবার ভয় পাচ্ছেন, ‘কমরেড’ ডাকের জেরে তৃণমূল মহল্লায় না সমস্যা পড়তে হয়!
তবে আশা থাক আর আশঙ্কাই থাক, এ বারের ভোটে দেওয়াল ভেঙেছে ‘কমরেড’ই!