Lok Sabha Election 2024

গেরুয়া-চিস্তিয়ায় মিলে যাবে, স্বপ্ন দেখাচ্ছে ধন্নীপুর

অযোধ্যায় রামমন্দিরে গোটা দেশের পুণ্যার্থীদের ভিড়। হোটেল, রেস্তরাঁ, দোকানপাট সরগরম। পঁচিশ কিলোমিটার দূরের ধন্নীপুর অপেক্ষায়। অযোধ্যায় হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ। ধন্নীপুর উন্নয়নের ছোঁয়াটুকু পায়নি।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

ধন্নীপুর (অযোধ্যা) শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০২৪ ০৮:১১
Share:

ধন্নীপুরে প্রস্তাবিত মসজিদের জমি। —নিজস্ব চিত্র।

ধন্নীপুর কোন দিকে? কী ভাবে যাব?

Advertisement

অযোধ্যার রামমন্দিরের সামনে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেও উত্তর মেলে না। কেউ যেন নামই শোনেননি। সরযূর ঘাটের সামনে অটো, টোটো, রিকশার ভিড়। ধন্নীপুর কী ভাবে যাব? উত্তর মেলে, ‘ধন্নীপুর! সে আবার কোথায়!’

বেশি নয়। রামমন্দির থেকে মাত্র পঁচিশ কিলোমিটার দূর। লখনউ-ফৈজাবাদ হাইওয়ে ধরলে মাত্র আধ ঘণ্টার রাস্তা। তবু ধন্নীপুর অযোধ্যার কাছে এখনও অজানা, অচেনা। অথচ অযোধ্যার সঙ্গেই ভাগ্য জড়িয়ে গিয়েছে ধন্নীপুরের।

Advertisement

সুপ্রিম কোর্ট রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিবাদের রায়ে অযোধ্যার ২.৭৭ একর বিতর্কিত জমিতে রামমন্দির নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিল। মসজিদের জন্য বিকল্প ৫ একর জমি বরাদ্দ করার নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। সেই জমিই বরাদ্দ হয়েছে এই ধন্নীপুরে। কাঁটাতার দিয়ে জমি ঘেরা হয়েছে। সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড মসজিদ তৈরির জন্য ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশন তৈরি করেছিল। সে সব চার বছর আগের কথা।

গত ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় রামমন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি রামমন্দির নির্মাণের সাফল্যের ঢাক পিটিয়ে ভোট চাইছেন। প্রাণপ্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠানে গরহাজির থাকার জন্য কংগ্রেস তথা বিরোধীদের দুষছেন।

ধন্নীপুরে কাঁটাতার ঘেরা জমিতে ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশনের নাম লেখা একখানি বোর্ড একলা দাঁড়িয়ে। তাতে প্রস্তাবিত মসজিদের নকশার ছবি। সেই নকশাও অবশ্য পরে বদলে গিয়েছে। নতুন নকশাওয়ালা একখানা ছবি এঁটে দেওয়া হয়েছে কাঁটাতারে ঘেরা জমির পাশে মাজারের দেওয়ালে।

খালি জমিতে খাটিয়া পেতে বসেছিলেন মহম্মদ ইসলাম। তিনিই জমির কেয়ারটেকারের কাজ পেয়েছেন। আশেপাশে তাঁর পোষা ছাগল চরছে। মহম্মদ বলেন, ‘‘গ্রামে তো মসজিদও রয়েছে, মন্দিরও। একটা হাই স্কুল দরকার ছিল। একটা হাসপাতাল দরকার। চিকিৎসার জন্য লখনউ ছুটতে হয়। মোটে একটা প্রাথমিক স্কুল গ্রামে। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। একটা কলেজও দরকার। ছেলেমেয়েগুলো পড়াশোনা শিখে মানুষ হবে।’’ আর মসজিদের দরকার নেই? মহম্মদ উত্তর দেন, ‘‘ধর্ম কী? ধর্ম তো রাস্তা। আল্লার কাছে পৌঁছনোর। আল্লার কাছে পৌঁছতে গেলে আগে তো মানুষ হতে হবে।’’

এমনিতে অবশ্য ধন্নীপুর চেনার মতো গ্রাম নয়। আছেটাই বা কী? আড়াই হাজার মতো লোকের বাস। তার মধ্যে শতকরা ৬৫ ভাগ মুসলিম পরিবার। বাকিটা মৌর্য, যাদবদের বাড়ি। এ দিকে, ও দিকে গরু, মোষ, ছাগল চরছে। রৌনহী থানা পেরিয়ে পাঁচশো মিটার এগোলে ধন্নীপুর গ্রামে চোখে পড়বে সুফি সাধক শাহ রহমতউল্লাহ আলেইয়ের মাজার। এপ্রিল মাসে তিন দিনের মেলা হয়ে গিয়েছে। কাওয়ালির আসর বসেছিল। তারপরে গাঁয়ের জীবন আবার নিস্তরঙ্গ। ভোট আসে। ভোট যায়। ধন্নীপুর অপেক্ষায় থাকে।

অযোধ্যায় রামমন্দিরে গোটা দেশের পুণ্যার্থীদের ভিড়। হোটেল, রেস্তরাঁ, দোকানপাট সরগরম। পঁচিশ কিলোমিটার দূরের ধন্নীপুর অপেক্ষায়। অযোধ্যায় হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ। ধন্নীপুর উন্নয়নের ছোঁয়াটুকু পায়নি। ভিন রাজ্যে কাজ করতে যেতে হয় আবিদ হুসেনকে। তিনি বলেন, ‘‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশের স্লোগান শুনি। সবকা বিকাশ দেখতে পাই না।’’ ধন্নীপুর উত্তর খোঁজে, মসজিদ কবে তৈরি হবে? মসজিদ হলে কি ধন্নীপুরে অযোধ্যার মতোই ভিড় জমবে? গাঁয়ের ছেলেপিলের রোজগারের সুযোগ তৈরি হবে?

সলমন ও প্রতীক যাদব দুই বন্ধু। বয়স বিশের কোঠায়। সলমনের মতো প্রতীকও চায়, ধন্নীপুর গ্রামে মসজিদ হোক। কেন? বাবরি মসজিদ নিয়ে এত দিনের বিতর্ক। তার বিকল্প মসজিদ তৈরি হবে ধন্নীপুরে। তা দেখতে নিশ্চয়ই দেশ-বিদেশের মানুষ আসবেন। প্রতীক তখন সলমনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রেস্তরাঁ খুলবে বলে ভেবে রেখেছে। সলমন-প্রতীক টিভিতে দেখেছে, মসজিদের শিলান্যাস হবে খুব শীঘ্রই। সেই ইট মক্কা, মদিনা ঘুরে এসেছে। মসজিদের সঙ্গে হাসপাতালও তৈরি হবে। কিন্তু কবে?

ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশনের কর্তারা বলছেন, ধন্নীপুর একইসঙ্গে ‘দুয়া’ ও ‘দাওয়া’-র ঠিকানা হবে। প্রার্থনাও হবে। চিকিৎসাও হবে। পাঁচ মিনারওয়ালা মসজিদের নাম হবে মহম্মদ বিন আবদুল্লা মসজিদ। সঙ্গে তৈরি হবে পাঁচশো বেডের হাসপাতাল। থাকবে খান দুয়েক কলেজ। বৃদ্ধাশ্রম। সব ধর্মের মানুষের জন্য নিরামিষ খাবারের লঙ্গর। অনুদান সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে কাজ সেরে ফেলার লক্ষ্য।

রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদের ক্ষত কি ঢেকে যাবে অযোধ্যায় রামমন্দির ও মসজিদের সহাবস্থানে? অযোধ্যায় জয় শ্রী রাম লেখা গেরুয়া ঝান্ডা উড়ছে। ধন্নীপুরের মসজিদে থাকবে গেরুয়া কাপড়ে বাঁধানো বিরাট মাপের কোরান। গেরুয়া ছিল অজমেঢ়ের খাজা মইনুদ্দিন চিস্তির প্রিয় রং। তাই মুসলিমদের কাছে গেরুয়ার নাম চিস্তিয়া।

ধন্নীপুর স্বপ্ন দেখায়, গেরুয়া-চিস্তিয়ায় মিলে যাবে রং। অযোধ্যা দেখাবে মন্দির-মসজিদ বিবাদ মেটানোর পথ। মহম্মদ ইসলামের কথা কানে বাজে—‘‘আল্লার কাছে পৌঁছতে গেলে আগে তো মানুষ হতে হবে।’’

(শেষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement