Lok Sabha Election 2024

হে ক্ষণিকের অতিথি! এটাই যাদবপুরের ডাক, পরম্পরা ভাঙার সুযোগ নেই এ বারও, এখানেই জন্ম মহাতারকার

যাদবপুর। শিক্ষা থেকে ঐতিহ্য অনেক কিছুতেই এগিয়ে। আবার এই আসনের নিজস্ব একটা পরম্পরাও রয়েছে। আবার এই আসন থেকেই রাজনীতির মহাতারকার জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল।

Advertisement

পিনাকপাণি ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০২৪ ২০:২৬
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

‘যাদবপুর লোকসভা আসনে সিপিএম প্রার্থী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় পরাজিত। ১৯,৬৬০ ভোটের ব্যবধানে জয়ী কংগ্রেস প্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’

Advertisement

১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলঘোষণার দিন আসলে অনেক জয়ের সূচনা হয়েছিল। ‘ওজনদার’ সিপিএম নেতা সোমনাথ যখন যাদবপুর লোকসভায় পরাজিত হলেন, তখন কে জানত তাঁর সেই পরাজয়ই এক দিন বাংলায় রাজনীতির নতুন অধ্যায় রচনা করবে। তার তিন দশক পরে যাদবপুরে জয় দিয়ে বাংলার রাজনীতির পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক দিন সোমনাথের দল সিপিএমকে ধরাশায়ী করে ইতিহাস তৈরি করবেন কে জানত!

যাদবপুর লোকসভার ইতিহাসে অনেক কাহিনি থাকলেও সবচেয়ে চমকপ্রদ গল্প মমতার উত্থানই। রাজ্য রাজনীতিতে এক তারকার জন্ম হয়েছিল এই যাদবপুরে। যিনি ভবিষ্যতে মহাতারকা হবেন।

Advertisement

পরে যাদবপুরে অনেক ক্ষেত্রের তারকা এসেছেন। জিতেওছেন। কিন্তু তাঁরা কেউ ‘রাজনীতির তারকা’ হতে পারেননি। তবে পরবর্তীকালে লোকসভার স্পিকার হওয়া সোমনাথ বা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতার সঙ্গে বাকি তারকাদের একটা মিল রয়েছে। ১৯৭৭ সাল থেকে যাদবপুর লোকসভার রেওয়াজ, কোনও সাংসদ তাঁর পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করলে আর তিনি ওই আসন থেকে সংসদে যেতে পারেন না। সোমনাথ, মমতার পরে মালিনী ভট্টাচার্য, কৃষ্ণা বসু, সুজন চক্রবর্তী, কবীর সুমন, সুগত বসু, মিমি চক্রবর্তীরারা সকলেই পাঁচ বছর মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরে আর যাদবপুর থেকে সাংসদ হননি। মালিনী ও কৃষ্ণা একাধিক বার জিতলেও পাঁচ বছরের মেয়াদ একটি করেই।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

যাদবপুর শুনলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা মনে আসে। যাদবপুর মানেই দেশভাগের স্মৃতি এবং উদ্বাস্তু সমস্যা, উগ্র বামপন্থা, এইট-বি বাস স্ট্যান্ড। ১৯৫২ সালের প্রথম লোকসভা নির্বাচনের সময় যাদবপুর বলে কোনও কেন্দ্রই ছিল না। সেই সময় কলকাতা দক্ষিণ-পশ্চিম লোকসভার অংশ ছিল বর্তমান যাদবপুরের বড় অংশ। ১৯৭৭ সালের আসন পুর্নবিন্যাসে জন্ম হয় যাদবপুরের। তখন বারুইপুর, যাদবপুর, কবিতীর্থ, মগরাহাট পশ্চিম, বিষ্ণুপুর পূর্ব, বেহালা পূর্ব এবং বেহালা পশ্চিম বিধানসভা নিয়ে ছিল যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র।

প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর দেহরক্ষীদের হাতে খুন হয়ার পরে ১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রবল সভানূভূতির ঝড় ওঠে কংগ্রেসের পক্ষে। সেই হাওয়ায় ভর করে পশ্চিমবঙ্গে ১৬টি লোকসভা আসন জেতে কংগ্রেস। যাদবপুরে সিপিএমের দাপুটে আইনজীবী প্রার্থী সোমনাথের বিরুদ্ধে প্রার্থী করা হয় কংগ্রেসে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ‘অনুগামী’ বলে পরিচিত যুবনেত্রী মমতাকে। সেই নির্বাচনেই সোমনাথকে ধরাশায়ী করে রাজনীতির পথ চলা শুরু মমতার। তবে ১৯৮৯ সালে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়ায় সিপিএম প্রার্থী মালিনী ভট্টাচার্যের কাছে পরাজিত হন মমতা। তার পরে অবশ্য আর যাদবপুরে প্রার্থী হননি তিনি। ১৯৯১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে দক্ষিণ কলকাতাতেই জিতেছেন।

১৯৮৯ সালের পর ১৯৯১ সালেও সিপিএমের অধ্যাপিকা প্রার্থী মালিনী দ্বিতীয় বার জেতেন। কিন্তু ১৯৯৬ সালে সিপিএম আবার ওই আসনে মালিনীকে প্রার্থী করলে কৃষ্ণা বসু বাজিমাত করে যাদবপুরের লাল দুর্গে ‘হাত’ প্রতীকে জয় পান। তার পরে ভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলেছিল বাংলার রাজনীতিও। যার প্রভাব যাদবপুর লোকসভাতেও পড়েছিল। ১৩ দিনের হলেও প্রথম বার কেন্দ্রে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে সরকার গঠন করেছিল বিজেপি। সেই সরকার ১৩ দিনে পড়ে গেলেও তত দিনে বাজপেয়ীর ভাবমূর্তি ঘিরে নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল। এমন সন্ধিক্ষণে বাংলার রাজনীতিতে কংগ্রেস ক্রমশ আড়াআড়ি ভাবে বিভাজিত হচ্ছিল। বাজপেয়ীকে সরিয়ে একাধিক বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি মিলিয়ে কেন্দ্রে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী হন এইচ ডি দেবগৌড়া। কংগ্রেস বাইরে থেকে সমর্থন দিয়েছিল সেই সরকারকে। পৌনে দু’বছরের সরকারে প্রধানমন্ত্রীও বদল হয়েছিল। দেবগৌড়ার পর প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ইন্দ্রকুমার গুজরাল। সেই সরকারও বেশিদিন টেকেনি। তাই ১৯৯৮ সালের গোড়াতেই বেজে গিয়েছিল অকাল লোকসভা নির্বাচনের দামামা।

তত দিনে বাংলায় কংগ্রেস ভেঙে নতুন দল তৈরি করেছেন মমতা। ১ জানুয়ারি তাঁর নতুন দল তৃণমূল কংগ্রেস তৈরির ঘোষণার মাত্র দেড়মাসের মধ্যেই ভোটে লড়তে হয়েছিল তাঁকে। বিজেপির সঙ্গে জোট গড়ে এগিয়েছিলেন মমতা। তখন অজিত পাঁজা, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেতারা কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন। লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থীও হন। যাদবপুর লোকসভার সাংসদ কৃষ্ণাও তৃণমূলে যোগদান করে আবার প্রার্থী হন। সেই ভোটে মালিনীকে সিপিএম ফের প্রার্থী করেছিল। কিন্তু সহজে জয় পান কৃষ্ণা। দল গঠনের পরে প্রথম নির্বাচনেই যাদবপুরে জেতে তৃণমূল।

১৯৯৮ সালের লোকসভা ভোটের পর বিজেপিকে বাইরে থেকে সরকার গড়তে সমর্থন দিয়েছিলেন মমতা। কিন্তু জয়ললিতার সমর্থন প্রত্যাহারে ১৩ মাসেই পতন হয় বাজপেয়ী সরকারের। ১৯৯৯ সালে আবার বাংলায় বিজেপির সঙ্গে জোটে তৃণমূল লড়াই করে ন’টি আসন জেতে। সে বার যাদবপুরে সিপিএম প্রার্থী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়কে হারান কৃষ্ণা। তবে ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটে আর নিজের কেন্দ্রের মানুষের সমর্থন পাননি তিনি। সেই নির্বাচনে তৃণমূলের ভরাডুবিতে রক্ষা পায়নি যাদবপুরও। কৃষ্ণাকে হারিয়ে জয়ী হন সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী।

এর পরে আবার নির্বাচন ২০০৯ সালে। তত দিনে আসন পুর্নবিন্যাসের কারণে যাদবপুর লোকসভার রূপ এবং চরিত্র দুই’ই বদলে গিয়েছিল। যাদবপুর বিধানসভার সঙ্গে সোনারপুর উত্তর ও দক্ষিণ, বারুইপুর পূর্ব ও পশ্চিম এবং টালিগঞ্জ ও ভাঙড় বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে তৈরি হয়েছিল এই লোকসভা। তা ছাড়া, ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগেই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন ঘিরে রাজ্যে পালাবদলের ইঙ্গিত মিলতে শুরু করেছিল। সেই আন্দোলনে মমতা পাশে পেয়েছিলেন রাজ্যের বিদ্বজ্জনের একাংশকে। ‘প্রতিবাদী মুখ’ হিসাবে তৃণমূল নেত্রী যাদবপুরে প্রার্থী করেছিলেন ‘নাগরিক কবিয়াল’ কবীর সুমনকে। সুজনকে হারিয়ে জিতেওছিলেন সুমন। কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গে সাংসদ সুমনের সুসম্পর্ক থাকেনি বেশিদিন। সাংসদ হওয়ার মাস আটেকের মধ্যেই তৃণমূল নেতা শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর মতানৈক্য বেড়ে যায়। দূরত্ব তৈরি হয় সুমন-তৃণমূলের। এক সময়ে সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার কথাও ঘোষণা করে দেন এই সুমন। কিন্তু শেষমেশ সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর অনুরোধে পিছিয়ে আসেন।

২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলে ৩৪ বছরের বামশাসনের অবসান ঘটিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হন মমতা। তবে তাতেও কবীরের সঙ্গে দূরত্ব ঘোচেনি তৃণমূলের। পরে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে তাঁর সঙ্গে মমতার সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক হলেও তাঁকে আর প্রার্থী করার ‘ঝুঁকি’ নেননি তৃণমূলনেত্রী। বরং প্রাক্তন সাংসদ কৃষ্ণার পুত্র অধ্যাপক সুগতকে প্রার্থী করা হয়। সহজে জিতেও যান তিনি। সে বারও সিপিএমের প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন সুজন।

২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে আবার যাদবপুর আসনে ‘চমক’ দিয়েছিলেন মমতা। সুগতকে টিকিট না দিয়ে অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তীকে যাদবপুর লোকসভায় প্রার্থী করা হয়। তা নিয়ে সমালোচনাও হয়েছিল বাংলার রাজনৈতিক মহলে। যাদবপুরের মতো একটি ‘কুলীন’ রাজনৈতিক আসনে কী ভাবে এক জন বাণিজ্যিক সিনেমার অভিনেত্রীকে প্রার্থী করা হল! কবে সমালোচনার মুখেও নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেননি মমতা। সেই নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী করেছিল অধ্যাপক অনুপম হাজরাকে। সিপিএমের প্রার্থী ছিলেন আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য। দু’জনকেই ধরাশায়ী করে সাংসদ হন মিমি। তিনি জয়ী হন প্রায় তিন লাখ ভোটের ব্যবধানে। সিপিএমের থেকে লাখ খানেক বেশি ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে বিজেপি।

তবে এ বারের লোকসভা ভোটের আগেই মিমি জানিয়ে দেন, তিনি আর প্রার্থী হতে চান না। তবে ১০ মার্চ ব্রিগেড সমাবেশে তৃণমূলের প্রার্থিতালিকা ঘোষণার পর দেখা যায়, মিমির জায়গায় এক অভিনেত্রীকেই যাদবপুরের প্রার্থী করেছেন মমতা ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি তৃণমূল যুব কংগ্রেসের রাজ্য সভানেত্রী সায়নী ঘোষ। এ বার তাঁর লড়াই বিজেপির অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ময়দানে রয়েছেন সিপিএমের ছাত্র সংগঠনের নেতা সৃজন ভট্টাচার্যও। রাজনৈতিক শক্তির নিরিখে যাদবপুর তৃণমূলের কাছে ‘অতি নিরাপদ’ আসন। তাই সায়নীর জয় এই আসনে সময়ের অপেক্ষা বলেই দাবি করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। কারণ, এই লোকসভার অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রেরই বিধায়ক তৃণমূলের। যতগুলি পঞ্চায়েত ও পুরসভা রয়েছে, তার দখলও শাসকদলের হাতেই।

পরম্পরা বলছে, যাদবপুর লোকসভা থেকে পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হলেও কেউ দ্বিতীয় বার এই কেন্দ্র থেকে সংসদে যেতে পারেন না। সেই পরম্পরা এ বারেও বজায় রয়েছে। মিমি প্রার্থী হননি। বাকি যাঁরা মূল প্রতিদ্বন্দ্বী, তাঁরাও সকলেই প্রথম বার প্রার্থী হয়েছেন। তাই ৪ জুন যাদবপুর যে আবার ‘নতুন’ সাংসদ পেতে চলেছে, তা গণৎকার না হয়েও বলা যায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement