গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
গত বিধানসভার মতো এ বারের লোকসভাতেও ‘বাংলা এবং বাঙালি’ লাইনে প্রচারের অভিমুখ ঠিক করে ফেলেছে তৃণমূল। একে ভোটের মরসুম। তার উপর রাজ্য সরকার বাংলা বছরের প্রথম দিনটিতে ‘রাজ্য দিবস’ ঠিক করার পর প্রথম পয়লা বৈশাখ। রবিবার সেই সব সাতসতেরো মাথায় রেখেই বাংলার অধিকাংশ আসনে প্রচারের রূপরেখা তৈরি করেছে শাসকদল। অন্য দিকে, যে বিজেপির বিরুদ্ধে ‘বাংলাবিরোধী’ তকমা দিতে তৃণমূলের এই কৌশল, তারা সংগঠিত ভাবে, পরিকল্পনা করে না হলেও রবিবারের প্রচারকে পয়লা বৈশাখের আঙ্গিকেই রাখতে চাইছে।
বস্তুত, সম্ভবত এই প্রথম পয়লা বৈশাখ ‘রাজনৈতিক’।
বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটিতে দমদম লোকসভার তিনটি এলাকায় তিনটি বড় মিছিল করতে চলেছে তৃণমূল। বিরাটি, নিউ ব্যারাকপুর এবং দমদমে নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে মিছিলে থাকবেন সেখানকার প্রার্থী তথা বিদায়ী সাংসদ সৌগত রায়। সৌগত স্পষ্টই বলছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে লাইনে প্রচারের সুর বেঁধে দিয়েছেন, সেই লাইনেই পয়লা বৈশাখের প্রচার হবে— বিজেপি মানেই বাংলার বিরোধী, বাঙালির বিরোধী।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘বিজেপি বাংলায় জমি শক্ত করা মানে বাঙালিত্ব নষ্ট হওয়া।’’
সৌগত যতটা আগ্রাসী, দক্ষিণ কলকাতার তৃণমূল প্রার্থী তথা বিদায়ী সাংসদ মালা রায় আবার ততটা নন। মালার কথায়, ‘‘সকালে ৮৬ নম্বর ওয়ার্ডে সমস্ত পুজো কমিটি পয়লা বৈশাখের শোভাযাত্রা করবে। আমি সেখানে থাকব। তার পরে একটু বেলার দিকে কালীঘাটে যাব পুজো দিতে।’’ তবে পাশাপাশিই মালা বলছেন, ‘‘বিজেপিকে বাংলা-বিরোধী বলার কারণ তারা রাজ্যকে ভাতে মারছে। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা দিচ্ছে না। তার মানে আবার এই নয় যে, আমরা অবাংলাভাষীদের উদ্দেশ্য করতে চাইছি।’’ মালা কেন সৌগতর মতো বাঙালি অস্মিতা তথা জাত্যাভিমানকে সে ভাবে সামনে রাখতে চাইলেন না? অনেকের মতে মালার কেন্দ্র দক্ষিণ কলকাতায় বালিগঞ্জ, ভবানীপুর, বন্দর-সহ বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর অবাঙালি ভোটার রয়েছেন। সেই কারণেই মালা কিঞ্চিৎ ‘সংযমী’ হয়ে থাকছেন।
প্রসঙ্গত, বাঙালির পয়লা বৈশাখের সঙ্গে কালীঘাটের মন্দিরের পুজো অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। কালীর পুজো এবং হালখাতার শুভ উপচারে বাঙালি নববর্ষ শুরু করে পয়লা বৈশাখে। ঘটনাচক্রে, প্রতি বছরের মতো মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শনিবারেই (পয়লা বৈশাখের আগের সন্ধ্যায়) কালীঘাট মন্দিরে পুজো দিয়ে এসেছেন।
জলপাইগুড়ির তৃণমূল প্রার্থী নির্মলচন্দ্র রায় পয়লা বৈশাখে প্রচার করবেন শিলিগুড়িতে। বিশেষ পরিকল্পনা কী? নির্মল বলছেন, ‘‘পয়লা বৈশাখ বাঙালির নতুন বছর। ধূপগুড়িতে থাকলে পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করতাম। কিন্তু শিলিগুড়িতে তা হবে না। তবে প্রচারে অবশ্যই নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করব।’’ শিলিগুড়িতেও অবাঙালি ভোটের অঙ্ক রয়েছে বলে অভিমত অনেকের। শিলিগুড়ি পুর এলাকায় বিপুল সংখ্যক অবাঙালি ভোটার রয়েছেন। হতে পারে জনবিন্যাসের সমীকরণেই সেখানে পয়লা বৈশাখকে ততটা জোর দিয়ে ‘ফোকাস’ করা হচ্ছে না। বরং ধূপগুড়ি, ময়নাগুড়ি, মাল-সহ বাঙালি এলাকায় পয়লা বৈশাখের কর্মসূচি রাখছে শাসকদল।
আর বিজেপি? মেদিনীপুরের পদ্মপ্রার্থী অগ্নিমিত্রা পাল জানিয়েছেন, রবিবার সকালে মেদিনীপুর শহরের একটি মন্দিরে পুজো দেবেন। তার পর দিনভর তাঁর কর্মসূচি ‘পয়লা বৈশাখময়’ হয়ে থাকবে। পুজো দেওয়ার পর বৈশাখী শোভাযাত্রায় পা মেলাবেন অগ্নিমিত্রা। তার পর কখনও মিষ্টি বিতরণ করবেন, কখনও মাতবেন বৈশাখী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। এই কর্মসূচি কি বাঙালি-বিরোধী, বাংলা-বিরোধী আখ্যান নস্যাৎ করতে? অগ্নিমিত্রার জবাব, ‘‘আমি বাঙালি নই? শুভেন্দু অধিকারী, দিলীপ ঘোষ, সুকান্ত মজুমদার বাঙালি নন? তৃণমূল কি বাঙালিত্বের ইজারা নিয়ে রেখেছে?’’ তাঁর কথায়, ‘‘বাঙালি মেয়ে হিসেবে ছোট থেকে যে ভাবে পয়লা বৈশাখ পালন করেছি, সে ভাবেই করব। তৃণমূলের ওই আখ্যান মানুষই ছুড়ে ফেলে দেবেন। তৃণমূল ইতিহাস ভোলাতে চায়। তৃণমূল শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে মুছতে চায়। তাই ওরাই আসল বাংলা ও বাঙালির বিরোধী।’’
আরামবাগের বিজেপি প্রার্থী অরূপকান্তি দিগার এবং বর্ধমান পূর্বের পদ্মপ্রার্থী অসীম সরকারের কাছে অবশ্য ভোটের প্রচারই মূল লক্ষ্য। সেখানে পয়লা বৈশাখ ঘিরে বিশেষ পরিকল্পনা নেই। তবে দুই প্রার্থীই বলছেন, তৃণমূল যে প্রচার করছে, তাকে প্রতি পদে নস্যাৎ করছেন তাঁরা। তাই আলাদা করে পয়লা বৈশাখের বিষয় নেই। অসীমের কথায়, ‘‘তৃণমূল এত বাঙালি-বাঙালি করছে! বাংলা পড়তে পারা, লিখতে পারার কথা বলছে। ওদের কীর্তি আজ়াদ, ইউসুফ পাঠানেরা কি বাংলা লিখতে, পড়তে শিখে গিয়েছেন? সেই প্রশ্নের জবাব তো ওদের পয়লা বৈশাখে দিতে হবে।’’
সব ভোটেই রবিবারের প্রচারে প্রার্থীদের বিশেষ গুরুত্ব থাকে। তার উপর সে দিন যদি কোনও বিশেষ উৎসব থাকে, তা হলে তা আরও বর্ণময় হয়ে ওঠে। বাঙালি জাত্যাভিমানের নিরিখে তাই এ বারের পয়লার প্রচার বিশেষ ভাবে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।
২০১৯ সালের লোকসভা এবং ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে ভাল ফল করলেও বিজেপির গা থেকে ‘অবাঙালি’ তকমা একেবারে মুছে যায়নি। মধ্যবিত্ত সমাজ, শহুরে বা শহরতলির বাঙালিদের মধ্যে পদ্মশিবির সম্পর্কে কতটা আগ্রহ রয়েছে, তা অন্তত নির্বাচনী ফলাফল দিয়ে এখনও বোঝা যায়নি। সেই আখ্যানই লোকসভা ভোটের প্রচারে নির্মাণ করেছেন মমতা এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিষেকের পরিকল্পনায় ‘জনগর্জন’-এর অভিমুখই হল ‘বাংলা বিরোধীদের বিসর্জন’। তাঁরা বলছেন, কেন্দ্রীয় সরকার তথা কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি বাংলা এবং বাঙালিদের বিরোধী। সেই কারণেই তারা রাজ্যের খেটে-খাওয়া মানুষের (বাঙালির) টাকা আটকে রেখেছে। সেই আখ্যানকেই তারা রবিবারের প্রচারে ‘হাতিয়ার’ করবে। বাংলার শাসক তৃণমূল যখন ‘আরও বাঙালি’ হবে, তখন বিজেপি চাইবে ‘বাঙালি’ হতে। বিচারপতির চাকরি ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় একাধিক আলোচনায় তাঁর মধ্যবিত্ত বাঙালি মূল্যবোধের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। অনেকের মতে, মধ্যবিত্ত বাঙালির সঙ্গে দলের ‘সেতুবন্ধ’ হিসেবে অভিজিৎকে ব্যবহার করতে চাইছে পদ্মশিবির।
তবে তৃণমূল-বিজেপি দু’পক্ষই পয়লা বৈশাখকে ব্যবহার করতে চাইছে। কিন্তু বুঝে। এলাকা ধরে। জনবিন্যাসের হিসেব কষে।