গ্রাফিক— সনৎ সিংহ
বোড়ের হাতেও কখনও-সখনও রাজা মাত খান! দাবার চাল উল্টে গেলে এমনটা হতেই পারে। রবিবার বিতর্কিত ভোজপুরি তারকা পবন সিংহ আসানসোল থেকে তাঁর প্রার্থিপদ ফিরিয়ে নেওয়ার পর তৃণমূল বলছে, বিজেপিও সেই ‘উল্টো’ চালেই ধরাশায়ী। পবনকে বাঁচানোর কম চেষ্টা করেনি পদ্মের ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আইটি সেল। শনিবার রাত থেকেই কোমর বেঁধে মাঠে নেমে পড়েছিল তারা। কিন্তু তৃণমূলের আপাত নবীন আইটি সেল দেখিয়ে দিল, কী ভাবে তাদের নাকের তলা দিয়ে খেলা ঘুরিয়ে দিতে হয়।
শনিবার সন্ধ্যায় রাজ্যের ২০টি লোকসভা আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছিল বিজেপি। এর মধ্যে আসানসোল কেন্দ্রের প্রার্থী হিসাবে বিজেপি জানিয়েছিল পবন সিংহের নাম। পবন একজন ভোজপুরি গায়ক। আসানসোলের বর্তমান সাংসদ শত্রুঘ্ন সিন্হার ‘বিহারীবাবু’ ভাবমূর্তিকে টক্কর দিতেই যে তাঁকে বিহার থেকে বাংলায় টেনে আনা হয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি রাজনৈতিক মহলের। বিতর্কের শুরু তার পর থেকেই। হঠাৎই জানা যায়, বিহারের ভোজপুরি সিনেমার তারকার একটি ছবির গানে বাংলার মহিলাদের অসম্মান করা হয়েছে।
তৃণমূল মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তী নিজের এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) লেখেন, ‘‘ভোজপুরিতে প্রকাশিত পবনের বিভিন্ন গান এবং ভিডিয়োতে বাংলার মহিলাদের প্রতি অশালীনতা প্রকাশ পেয়েছে।’’ এই অভিযোগের পাল্টা বিজেপিও শত্রুঘ্নের একটি ছবির বিতর্কিত ক্লিপিং এবং রাজ্যের বিধায়ক সোহম চক্রবর্তীর সিনেমার গানের একটি দৃশ্যকে ‘অশালীন’ বলে ইঙ্গিত করে পাল্টা পোস্ট করেন সমাজমাধ্যমে। শুরু হয় দুই দলের আইটি সেলের যুদ্ধ।
বিজেপির আইটি সেল চলছে ১৯৯৯ সাল থেকে। গত ২৫ বছর ধরে তা ক্রমে নিজেদের আকারে এবং ক্ষমতায় বাড়িয়েছে। বিজেপির আইটি সেলের ক্ষমতা ঠিক কতখানি তা বোঝাতে গিয়ে এক বার স্বয়ং অমিত শাহ বলেছিলেন, ‘‘সত্যি হোক বা না হোক, জেনে রাখবেন, যে কোনও খবরকে আমরা নিমেষে ভাইরাল করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখি।’’
কী ভাবে এই কাজ তারা করেন, তার উদাহরণ-সহ ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন শাহ। একটি সর্বভারতীয় হিন্দি দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি সবিস্তার বলেছিলেন, কী ভাবে উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগে তাঁরা এই কাজ করেছিলেন। শাহর কথায়, ‘‘উত্তরপ্রদেশে বিজেপি দু’টি হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপ চালাত। একটিতে ১৭ লক্ষ সদস্য ছিল। অন্যটিতে ছিল ১৫ লক্ষ। এই ৩২ লক্ষ মানুষের কাছে রোজ সকাল ৮টায় সুপ্রভাতের শুভেচ্ছা-সহ আরও একটি বার্তা যেত। যে বার্তা তাঁরা নিজেদের পরিচিত মহলে আরও লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে ফরোয়ার্ড করে দিতেন। ওই বার্তাতেই বলে দেওয়া হত, ওই দিনে কী নিয়ে কথা বলা হবে। কোন বিষয়টিকে প্রচার করা হবে। এমনকি, কোন ঘটনার কী ভাষ্য হবে, তা-ও বলা থাকত সেই বার্তায়।’’ শাহ বলেছিলেন, এই ভাবে একবার বিজেপির নেটওয়ার্কে ভুল করে ছড়িয়ে গিয়েছিল অখিলেশ যাদব তাঁর বাবা মুলায়ম সিংহ যাদবকে থাপ্পড় মেরেছেন। ভুল করে করা ওই পোস্ট আর আটকানো যায়নি। তা মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়েছিল কোটি কোটি মানুষের কাছে। এ হেন বিজেপির আইটি সেল মাঠে নেমেছিল পবনকে বাঁচাতে।
পাল্টা তৃণমূলের আইটি সেল ততোধিক জোর দিয়েছিল ভোজপুরি গায়কের বিরুদ্ধে পরের পর প্রচার চালানোর ব্যাপারে। শত্রুঘ্ন এবং সোহমকে নিয়ে বিজেপি ওই পোস্ট করার পর তৃণমূলের আরও এক মুখপাত্র ঋজু দত্ত নিজের এক্স হ্যান্ডেলে এক ভোজপুরি অভিনেত্রীর কথা উল্লেখ করে লেখেন, ‘‘ভোজপুরি অভিনেত্রী অক্ষরা সিংহ আসানসোলের মানুষকে কিছু বলতে আসবেন। অপেক্ষা করুন।’’
এই প্রচার শুধু শনিবারেই থামেনি। ভোটের ফলাফল ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত যে তৃণমূলের এই আক্রমণ চলবে, তা বোঝা গিয়েছে রবিবার সকালেও। তৃণমূলের প্রতীকে রাজ্যসভা নির্বাচনে সদ্যজয়ী সাংবাদিক সাংসদ সাগরিকা ঘোষ প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘নহম হাসিনা বাঙ্গাল কি। আসানসোলের বিজেপি প্রার্থীর একটি গানের ভিডিয়োতে বাংলার নারীদের নিচু করে দেখানো হয়েছে। আমরা কি এই ধরনের জনপ্রতিনিধি পেতে চাইব?’’
এর মধ্যেই বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা তথাগত রায়ও নিজের এক্স হান্ডেলে আসানসোলের বিজেপি প্রার্থীবদলের দাবি তুলে লেখেন, ‘‘আসানসোল কিন্তু বিহারে নয়।’’ যা তৃণমূলের পক্ষে যায়। আর এই আক্রমণের পারদ চড়তেই রবিবার দুপুরেই পবন জানিয়ে দেন, তিনি আসানসোলে বিজেপি প্রার্থী হিসাবে লড়তে চান না।
বিশেষ কারণটি কী? তা সমাজমাধ্যমের ওই পোস্ট স্পষ্ট করেননি পবন। যদিও তাঁর বিরুদ্ধে শনিবার সন্ধ্যা থেকে রবিবার রাত পর্যন্ত চলা প্রচারই যে এর কারণ, সে ব্যাপারে অনেকেই নিশ্চিত। ভোজপুরি সিনেমা জগতের খবর, তৃণমূলের প্রচারে যে ভোজপুরি অভিনেত্রীর কথা বলা হয়েছে, সেই অক্ষরাকে নিয়ে দীর্ঘ বিতর্কের মুখোমুখি হয়েছিলেন ভোজপুরি তারকা। বিষয়টি তাঁর পরিবার পর্যন্তও গড়িয়েছিল বলে খবর। এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, অক্ষরাকে নিয়ে প্রচারের পরই নতুন করে আর বিতর্কে জড়াতে চাননি পবন। তৃণমূল নেতৃত্বের অনেকেই মনে করছেন, বিজেপির ঘোষিত আসানসোল প্রার্থী কার্যত তৃণমূলের প্রচারে শঙ্কিত হয়েই প্রার্থী পদ প্রত্যাখ্যান করেছেন। রবিবার পবনের ওই পোস্ট প্রকাশ্যে আসতেই সমাজমাধ্যমে পাল্টা পোস্ট করেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লেখেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ‘অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং ক্ষমতা’-র জয় হল।’’