Lok Sabha Election 2024

আখলাক-ছায়ায় ভয় রয়েছে আজও

আলিগড়-মোরাদাবাদ-রামপুর-বিজনোর-মুজফফ্‌রনগর হয়ে সাহারনপুর— পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষিবহুল এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে সহাবস্থান করেছে জাঠ ও মুসলিম সমাজ।

Advertisement

অনমিত্র সেনগুপ্ত

আলিগড় শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:৪৯
Share:

আলিগড় থেকে তৃতীয় বারের জন্য প্রার্থী হয়েছেন বিজেপির সতীশ গৌতম। — ফাইল চিত্র।

দশ বছর আগেকার আখলাক-কাণ্ড আজও অলিখিত সতর্কবার্তা পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে।

Advertisement

গরুর মাংস রয়েছে বলে স্রেফ সন্দেহের বশে পিটিয়ে মারা হয়েছিল বিসারা গ্রামের মহম্মদ আখলাককে। সেই ভয়ের রেশ রয়ে গিয়েছে আজও। তাই ট্রেনে রান্না করা খাবার নিয়ে ওঠার সাহস করেন না আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বশির আলি, জুনেদ খানেরা। ওঁদের ভয়, পাছে খাবার দেখে কেউ আঙুল তোলে। সন্দেহের আঙুল যে মৃত্যু ডেকে আনে!

আলিগড়-মোরাদাবাদ-রামপুর-বিজনোর-মুজফফ্‌রনগর হয়ে সাহারনপুর— পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষিবহুল এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে সহাবস্থান করেছে জাঠ ও মুসলিম সমাজ। কিন্তু দশ বছর আগের সংঘর্ষ পাল্টে দিয়েছে অনেক সমীকরণ। ভোটের হালচাল বুঝতে এই এলাকাগুলি ঘুরে সার নির্যাস—বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক থেকে সাধারণ ফল বিক্রেতা, পড়ুয়া থেকে সরকারি চাকুরিজীবী, মুসলিম সমাজের উপর থেকে নীচে, সকলের মনে ভয়, কখন কী হয়! সেই ভয় এমন পর্যায়ে যে আগন্তুক দেখলে দু’একটি বাক্যের পর মুখ বন্ধ রাখেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ভোট, তিন তালাক, রাম মন্দির, জন্মনিয়ন্ত্রণ আইনের কথা তুললে মনে হয়, এ সব যেন ভিন্‌ গ্রহের বিষয়।

Advertisement

রোজা ভাঙার পরে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল প্রবেশদ্বারের উল্টো দিকের দোকানে ভিড় জমান পড়ুয়ারা, জেনেছিলাম আলিগড়ে পৌঁছেই। সন্ধ্যা নামতেই মোরাদাবাদ বাইপাসে, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিভাগের গেটের সামনে কয়েকশো ছাত্রের ভিড়। সেখানে চায়ের দোকানে আলাপ বশির খানের সঙ্গে। মোরাদাবাদের বশির এমএসসি করছেন মিউজ়িয়োলজি নিয়ে। বিষয়টি পড়ে মিউজ়িয়ামে কিউরেটর পদে সরকারি চাকরি যে পাবেন সেই ভরসা নেই। কারণ, দেশের আর পাঁচটি পড়ুয়ার মতোই বশির জানেন, সরকারি চাকরির বাজার কতটা মন্দা। চায়ের দোকানের মালিক ইরফানের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বশির বলেন, ইরফান আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। চাকরি না পেয়ে এখন চায়ের দোকান খুলেছে। তবে তাঁর নিজের ইচ্ছে গবেষণা করে বিদেশ যাওয়ার। চাকরির শিকে ছিঁড়বে এই আশায়।

এই বশিরই সাক্ষী থেকেছেন, ট্রেনে মুরগির মাংস নিয়ে কী ভাবে মারধর খেয়েছেন সিনিয়র সহপাঠী। বশিরের কথায়, ‘‘ওই দাদা বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরছিলেন। সঙ্গে খাবার ছিল। চিকেনের বাটি খুলতেই সহযাত্রীরা সন্দেহ করেন। মুরগির মাংস বলা সত্ত্বেও রেহাই মেলেনি। কেন মাংস নিয়ে ট্রেনে উঠেছিল, তার জন্য চড়-চাপড় খেতে হয়। ভাগ্যিস, কামরার অন্য কিছু যাত্রী বাঁচিয়ে দেন।’’ সেই ঘটনার পর থেকে বাড়ির লোকেরা বশিরকেও রান্না করা খাবার দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

বশিরের পাশে বসে চা খাচ্ছিলেন বন্ধু জুনেদ। প্রায় আধ ঘণ্টা আড্ডার পরে কিছুটা খোলামেলা হলেন। বললেন, ‘‘দমবন্ধ অবস্থা আমাদের। এখন প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামতে ভয় পাচ্ছে পড়ুয়ারা। গ্রেফতার তো হতে হবেই, সঙ্গে বাড়িতে বুলডোজার চলার আশঙ্কা। কে ঝামেলা চায়! কড়া নজরদারির মধ্যে রয়েছি আমরা। রাষ্ট্র প্রতিপদে বুঝিয়ে দিতে চাইছে আমরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।’’

বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মুস্তাফা জাইদিও মেনে নেন, ‘‘অতীতে পরিস্থিতি এমন ছিল না। কিন্তু এখন বিভাজন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।’’ ফলের রস বিক্রেতা আখতারও বলছেন, ‘‘এক সময়ের বাঁধা হিন্দু খদ্দেররাও আজকাল আমার দোকানে ফলের রস খেতে আসেন না। তাঁরা যাচ্ছেন হিন্দু ফল বিক্রেতাদের কাছে।’’ তীব্র এক মেরুকরণের হাওয়া কেবল আলিগড়েই নয়, টের পাওয়া যায় গোটা পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ ঘিরেই।

তালা ও তালিম (শিক্ষা)-এর শহর বলেই প্রসিদ্ধ আলিগড়। মুসলিমদের আধুনিক শিক্ষাদানে তৈরি হয়েছিল আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়। তবে আগামী দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিমদের সংরক্ষণ থাকবে কি না তা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। অধ্যাপক জাইদির কথায়, মূলত মুসলিমদের শিক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হলেও, কখনও তা সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা নেয়নি। অনেকের মতে সেটাই সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেশের আর পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মতো ছাত্র ভর্তিতে সংরক্ষণ নীতি চালু হবে না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিষয়টি বর্তমানে বিচারাধীন।

স্থানীয় হোটেলকর্মী সুজাতা কাশ্যপ সংরক্ষণের দাবিতে সরব। তাঁর যুক্তি, ‘‘আমার ছেলে ভাল নম্বর করা সত্ত্বেও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে গোড়ায় জায়গা পায়নি। গোটা দেশের মুসলিম ছাত্রদের জায়গা করে দেওয়ার পরে পঞ্চম তালিকায় আমার ছেলের নম্বর ওঠে। অথচ, আমার ছেলের যা নম্বর ছিল তাতে দ্বিতীয় তালিকায় নাম ওঠা উচিত ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সংরক্ষণ নীতি যোগ্যদের আটকে দেয়।’’ সুজাতা মনে করেন, মোদী-যোগী শাসনে আগামী দিনে ওই নীতি অবশ্যই পাল্টাবে।

আলিগড় থেকে তৃতীয় বারের জন্য প্রার্থী হয়েছেন বিজেপির সতীশ গৌতম। তিনি যে হ্যাটট্রিক করতে চলেছেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই তামাম আলিগড়ের। ‘উত্তরপ্রদেশ ডিফেন্স করিডর’ আলিগড়ের উপর দিয়ে যাওয়ায় সতীশ দু’হাতে জলের দরে জমি কিনেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে ঠিকই, তবে আলিগড়ে গান্ধী চকের বিজেপি দফতরে বসে দুর্নীতির যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে দিলেন প্রচারের দায়িত্বে থাকা প্রদীপ পাণ্ডে। তিনি বলেন, ‘‘রাজনীতিতে থাকলে এমন একটা-দু’টো অভিযোগ বিরোধীরা করবেই।’’

মেরুকরণের হাওয়া, মুসলিম সমাজের ভয় প্রসঙ্গে প্রদীপের ব্যাখ্যা, ‘‘আগে দেশের কোথাও গন্ডগোল হলে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা স্টেশন অবরোধ করে শহর অচল করে দিত। যা শক্ত হাতে এখন প্রশাসন বন্ধ করে দিয়েছে। এখন বিক্ষোভ হলে তা ক্যাম্পাসে হয়। এতে হিন্দু-মুসলিম সকলেই উপকৃত হয়েছেন। সমাজবাদী সরকারে নিয়ম না মানাটাই নিয়ম ছিল। এখন প্রশাসন শক্ত ব্যবস্থা নিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থা শুধরেছে, দখলদারি উচ্ছেদ করে রাস্তা চওড়া করেছে, সংঘর্ষকারীদের সম্পত্তি ক্রোক করেছে। রাত ৯টার পরে মহিলারা বেরোতে পারতেন না। এখন রাত ১২টা পর্যন্ত খাবারের দোকান খোলা থাকছে।’’ তবে তাঁর সংযোজন, ‘‘সার্বিক ভাবে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে। এর জন্য কিছু দাম তো দিতেই হবে। আসলে নিয়মে থাকতে হচ্ছে বলেই যত হাঁসফাঁস। কিন্তু এটাই ভারসাম্যের রাজনীতি। উন্নয়নের রাজনীতি।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement