জয়ললিতার সমাধিক্ষেত্র। — নিজস্ব চিত্র।
চেন্নাইয়ের মেরিনা সৈকতে জে জয়ললিতার সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে দুই তরুণী মোবাইলে ‘নিজস্বী’ তুলছিলেন। পিছনে জয়ললিতার বিরাট ছবিকে রেখে। এমএ পাশ করে এখন চাকরি করছেন। সমুদ্রের ধারে মাছ ভাজা-কুলফি ছেড়ে জয়ললিতার সমাধিতে কেন? দুই তরুণী উত্তর দিলেন, হাই স্কুলে পড়ার সময় জয়ললিতা সরকারের দেওয়া ‘আম্মা ল্যাপটপ’ পেয়েছিলেন। পড়াশোনা এগিয়েছিল সেই ল্যাপটপের হাত ধরে। তাই মেরিনা সৈকতে এলে একবার ‘আম্মা’-কে প্রণাম জানিয়ে যান। বিদায় নেওয়ার আগে দুই তরুণীই তামিলে বললেন, ‘আম্মা ভাজঘা’। যার অর্থ, আম্মা অমর রহে।
ঠিক দশ বছর আগে, ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের সময় তামিলনাড়ুর রাজনীতির ছবি মনে পড়ে গেল। পশ্চিম ভারত থেকে গুজরাত নামের এক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজেকে প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসেবে তুলে ধরছিলেন। তাঁর নাম নরেন্দ্র মোদী। অন্য দিকে দক্ষিণ ভারত থেকে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতাও নিজেকে প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। চেন্নাই জুড়ে তখন হোর্ডিংয়ে দিল্লির সংসদ ভবনের প্রেক্ষাপটে জয়ললিতার ছবি দেখা যেত। প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য দুই মুখ্যমন্ত্রীর লড়াইয়ের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘লেডি বনাম মোদী’।
গত দশ বছরে চেন্নাইয়ের কুয়ম নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। আট বছর আগে জয়ললিতার মৃত্যুর পরে তাঁর এডিএমকে বিজেপির সঙ্গে কখনও প্রকাশ্যে, কখনও গোপনে আঁতাঁত করেছে। আর এ বার লোকসভা নির্বাচনে সেই বিজেপির সঙ্গ ছেড়ে একাই লড়ছে এডিএমকে। ১৯ এপ্রিল তামিলনাড়ুর ৩৯টি আসনে ভোটগ্রহণ। দশ বছর আগে এডিএমকে-র নেত্রী দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। দশ বছর পরে সেই এডিএমকে-রই অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। কারণ, বিজেপি এডিএমকে-র ভোটব্যাঙ্কে ধস নামিয়ে তামিলভূমে তৃতীয় শক্তি হিসেবে উঠে আসতে চাইছে।
জয়ললিতার মৃত্যুর পরে তাঁর উত্তরাধিকারী হওয়ার লড়াই নিয়ে গৃহযুদ্ধ বেধেছিল। প্রথমে জয়ললিতার অনুগামী ও পনীরসেলভম মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। এডিএমকে নেতৃত্বের অভিযোগ, জয়ললিতার দলকে দুর্বল করতে বিজেপি পনীরসেলভমকে নিজের দিকে টেনে নিয়েছে। তিনি এ বার বিজেপির সমর্থনে নির্দল প্রার্থী হিসেবে ভোটে লড়ছেন। জয়ললিতার পরে তাঁর প্রিয় বান্ধবী শশীকলা দলের হাল ধরবেন বলে মনে করা হয়েছিল। দুর্নীতির দায়ে জেল খাটার পরে তিনি এখন স্বেচ্ছাবসরে। তাঁর ভাইপো টি টি ভি দীনাকরণ এডিএমকে-র কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। তিনিও এডিএমকে ভেঙে নিজের দল গড়ে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। এখন জয়ললিতার আর এক অনুগামী ই কে পলানীস্বামী দলের ভাঙন রুখে রাশ ধরেছেন। তাঁর নেতৃত্বেই এখন এডিএমকে-র অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
মেরিনা সৈকতে এম জি রামচন্দ্রনের সমাধির পাশেই জয়ললিতার সমাধি। অল্প দূরে আলোয় ঝলমল করছে ভিয়েতনাম থেকে আনা মার্বেল পাথরে তৈরি করুণানিধি এবং সি এন আন্নাদুরাইয়ের স্মৃতিসৌধ। দেখলেই বোঝা যায়, তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে এখন করুণানিধির পুত্র এম কে স্ট্যালিন। সেই তুলনায় শান্ত পরিবেশে জয়ললিতার সমাধি নিষ্প্রভ। অনেকটা তাঁর দলের মতোই। বিজেপি নেতা চন্দ্রনের যুক্তি, ২০১৪-তে জয়ললিতা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এডিএমকে তামিলনাড়ুর ৩৯টির মধ্যে ৩৭টি আসন জিতেছিল। কিন্তু দেশের সরকারে তাঁদের কোনও ভূমিকা ছিল না। ২০১৯-এও ডিএমকে-জোট ৩৯টির মধ্যে ৩৯টি সাংসদ আসন জিতেছে। কিন্তু দেশের সরকারে তাঁদের কোনও ভূমিকা নেই। তামিলনাড়ুর মানুষ এ বার জাতীয় রাজনীতির মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইছেন। একাধিক এনডিএ প্রার্থী এ বার তামিলনাড়ু থেকে জিতে লোকসভায় সাংসদ হবেন।
চেন্নাইয়ের রয়াপেট্টা-তে এডিএমকে-র সদর দফতরের উঠোনে দলের প্রতিষ্ঠাতা এম জি রামচন্দ্রন ও তাঁর উত্তরাধিকারী জয়ললিতার সোনালি মূর্তির পাশে এখন পলানীস্বামীর হাসি মুখের ছবি। ভিতরে বসে এডিএমকে-র নেতা ডি জয়কুমার বলছিলেন, বিজেপির সঙ্গ হল ‘ধৃতরাষ্ট্রের আলিঙ্গন’। সাবধান না হলেই মৃত্যু অনিবার্য। তাঁর বক্তব্য, “তামিলনাড়ুতে আসল লড়াই ডিএমকে বনাম এডিএমকে। বিজেপির পায়ের নীচে কোনও জমি নেই। আম্মা সব সময় বলতেন, এই সব জাতীয় দল আমাদের ঘাড়ে বোঝার মতো। এত দিন ঘাড়ে চাপার পরে বিজেপি এখন আমাদেরই শেষ করতে চাইছে। কিন্তু আম্মার উত্তরাধিকার আমাদের সঙ্গে।”
আম্মার উত্তরাধিকার ধুলোয় মিশিয়ে বিজেপি কি তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে মাথা তুলতে পারবে? তামিলনাড়ু বিজেপির সদর দফতর কমলালয়ম-এ ঢুকলেই দুই দেবীমূর্তি। একটি ভারতমাতার। তাঁর হাতে গেরুয়া পতাকা ঝুলছে। পাশে তামিল তাই-এর মূর্তি। তামিল নবজাগরণের সময় তামিল ভাষাকেই তাই বা মা রূপে পুজো করা হত। শিবগঙ্গায় এই তামিল তাই-এর মন্দিরও রয়েছে। সেই দেবীমূর্তিই বসানো হয়েছে বিজেপির রাজ্য দফতরে। ভারত মাতার পাশে।
বার্তা স্পষ্ট। আম্মার স্মৃতি ভোলাতে বিজেপি দাক্ষিণাত্যে ভারতমাতা ও তামিলমাতাকে মেলাতে চাইছে!