আন্নামালাই। — নিজস্ব চিত্র।
আপনি কি তামিলনাড়ুর রাজনীতির দিলীপ ঘোষ? যিনি বাংলার মাঠে নেমে হোক বা নিত্যনতুন বিতর্কিত মন্তব্য করে, বিজেপিকে রোজ খবরে রাখেন? সেখান থেকে শুরু করে রাজ্য রাজনীতিতে বহু দিনের ব্রাত্য বিজেপিকে লোকসভা, বিধানসভায় ভোটে প্রধান বিরোধী দলের জায়গায় তুলে আনেন? কুপ্পুস্বামী আন্নামালাইকে এই প্রশ্নগুলো করা হয়নি। তবে জিজ্ঞাসা করা গিয়েছিল, আপনার বয়স তো মাত্র ৩৯ বছর। এই বয়সেই আপনার কাঁধে তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যের ৩৯টি লোকসভা আসনের দায়িত্ব?
প্রশ্ন করলে তামিল ভূমে বিজেপির রাজ্য সভাপতি কুপ্পুস্বামী ওরফে কে আন্নামালাই দাঁত বার করে হাসেন। তার পরে বলেন, “এই লোকসভা নির্বাচনে সবাই আগেই জেনে গিয়েছেন, নরেন্দ্র মোদী তৃতীয় বার ক্ষমতায় আসছেন। আমার বিশ্বাস, নরেন্দ্র মোদীর ৪০০ সাংসদের মধ্যে এ বার তামিলনাড়ু থেকে অনেক সাংসদ থাকবেন। এনডিএ তামিলনাড়ু থেকে রেকর্ড ভোট পাবে।’’
কথার ঝাঁঝেই বোঝা যায়, মাত্র আট বছর আইপিএস হিসেবে পুলিশের চাকরিতে দাপটের জেরে কেন তাঁর নাম হয়েছিল ‘সিংহম আন্না’। বাংলায়, সিংহ-দাদা। পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় অজয় দেবগণের মারকাটারি অ্যাকশন ছবি ‘সিংহম’-এর অনুপ্রেরণায়। চেন্নাই থেকে কোয়েম্বত্তূরের রাস্তায় প্রচারে নামলে এখন তাঁর সঙ্গে নিজস্বী তুলতে তরুণ-তরুণীরা এমন হাঁকপাক করেন, মনে হয়, তিনি সত্যিই রূপোলি পর্দার ‘সিংহম’। এই ‘সিংহম আন্না’-কেই দিলীপ ঘোষের ধাঁচে উল্টোপাল্টা মন্তব্য করে বিতর্ক বাঁধানোর জন্য ডিএমকে নেতারা ‘জোকার’ বলে ডাকেন।
সিংহম হোন না জোকার, দু’দিকেই বিজেপির লাভ। কারণ, বিজেপি সবসময় খবরের শিরোনামে। বিজেপির রাজ্য সহ-সভাপতি এম চক্রবর্তী নির্দ্বিধায় বলেন, ‘‘আন্নামালাই বিজেপি সভাপতি হওয়ার পরে গোটা তামিলনাড়ুর মানুষের নরেন্দ্র মোদী সরকারের কাজ, বিজেপির চিন্তাভাবনা সম্পর্কে আগ্রহ বেড়েছে। তামিলনাড়ুর সবাই এখন আন্নামালাইকে এক ডাকে চেনেন।’’
কৃষক পরিবারের সন্তান ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে লখনউয়ের আইআইএম থেকে এমবিএ করেছিলেন। তার পরে কর্নাটক ক্যাডারের আইপিএস। চার বছর আগে চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে নেমে বিজেপিতে যোগদান। এক বছর পরেই বিজেপির রাজ্য সভাপতি। তা-ও এমন এক রাজ্যে, যেখানে বিজেপির ট্র্যাকরেকর্ড খুব ভাল হলেও ৩ থেকে ৫ শতাংশ ভোট। ২০১৪-য় প্রবল মোদী-ঝড়েও মাত্র একটি আসন। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে সেটাও হাতছাড়া। এ বার তাই শূন্য থেকে শুরু।
এ হেন তামিলনাড়ুর দিলীপ ঘোষ, থুড়ি আন্নামালাইয়ের কাঁধে ভর করেই এ বার বিজেপি রাজ্যের শাসক দল ডিএমকে-র বিরোধিতায় প্রধান শক্তি হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখছে। দ্রাবিড় রাজনীতির চিরাচরিত ডিএমকে বনাম এডিএমকে লড়াইয়ের বাইরে তামিল জনগণকে নতুন বিকল্পের সন্ধান দিতে চাইছে। এত দিনের শরিক এডিএমকে-কে ছেড়ে বিজেপি অম্বুমানি রামাডসের পিএমকে-সহ কিছু ছোট ছোট দলের সঙ্গে জোট করেছে। বিজেপি নিজে ৩৯টির মধ্যে ২৩টি লোকসভা আসনে লড়ছে। চেন্নাইয়ের টি নগরে বিজেপির রাজ্য দফতর ‘কমললয়ম’-এর নেতারা নিশ্চিত, দলের ভোটের হার দুই অঙ্কের ঘরে চলে যাবে। আন্নামালাই দাবি করছেন, “এটা তো বিধানসভার ভোট নয়। এখানে মানুষ জাতীয় রাজনীতির কথা ভেবে ভোট দেবেন। মোদী সরকারের তৃতীয় দফায় তামিলনাড়ুর কী ভূমিকা থাকছে, তা ভেবে মানুষ ভোট দেবেন।”
কন্যাকুমারী থেকে কোয়েম্বত্তূর, দৌড়চ্ছেন আন্নামালাই। নিজে কোয়েম্বত্তূর লোকসভা কেন্দ্র থেকে লড়ছেন। তার সঙ্গে দক্ষিণ চেন্নাই, নীলগিরি, বিরুধনগরের মতো একাধিক আসন বিজেপির পাখির চোখ। গোটা রাজ্যে সাত মাস ধরে ‘আমার রাজ্য, আমার মানুষ’ বা ‘এন মান, এন মাক্কাল পদযাত্রা’ করেছেন। বিতর্কও আন্নামালাইয়ের পিছনে পিছনে দৌড়চ্ছে। কখনও তিনি বলেছেন, ডিএমকে-র ষড়যন্ত্রে তামিলনাড়ুতে গরম বেড়েছে। কখনও বলেছেন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে রাজ্যের সমস্ত মন্দিরের সামনে থেকে পেরিয়ারের মূর্তি সরানো হবে। কারণ, পেরিয়ার বলেছিলেন, ভগবান বলে কিছু নেই, যারা ভগবানের পুজো করে তারা বোকা।
ডিএমকে-র আন্না আরিভলয়ম সদর দফতরে বসে দলের যুগ্ম সচিব সরভানন আন্নাদুরাই হেসে কুটোপাটি। ‘‘ভাবুন এক বার। পেরিয়ার ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে, জাতপাতের ভেদাভেদের বিরুদ্ধে দ্রাবিড় আন্দোলনের জনক। বিজেপির নেতা বলছেন, তাঁর মূর্তি সরাবেন। এঁকে সামনে রেখে বিজেপি তামিল ভোট পাওয়ার আশা করে? সাধে কি দয়ানিধি মারান ওঁকে জোকার বলেন।’’
ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতি বিদ্বেষ তামিল সমাজে অন্তর্নিহিত। বিজেপি তামিলনাড়ুতে কোনও ব্রাহ্মণকে প্রার্থীও করেনি। সংগঠনের মাথায় কোনও ব্রাহ্মণ নেতাকে রাখেনি। আন্নামালাই গৌনডার সম্প্রদায়ের মানুষ। যথেষ্ট প্রভাবশালী হলেও এই সম্প্রদায় অনগ্রসর শ্রেণির তালিকাভুক্ত। হিন্দি বলয়ে উচ্চবর্ণের দল বলে পরিচিত বিজেপির দ্রাবিড় ভূমে ভোট বাড়াতে মোদী তাঁর মতোই ওবিসি নেতা আন্নামালাইয়ের উপরে ভরসা করছেন।
এক কথায়, ‘জোকার’-ই হয়ে উঠেছে বিজেপির তুরুপের তাস।