প্রচারের ফাঁকে বাড়িতে শশী তারুর। — নিজস্ব চিত্র।
বেশ অনেক দিন আগের ঘটনা। কান্নুরের রাস্তা দিয়ে সতীর্থের সঙ্গে গল্প করতে করতে যাচ্ছিলেন লম্বা চুলের এক তরুণ। এক ফাঁকে পকেট থেকে মানিব্যাগটা পড়ে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে ব্যাপারটা আবিষ্কার করে মুষড়ে পড়েছিলেন। কয়েক দিন পরে ডাক-যোগে সেই মানিব্যাগ ফেরত আসে তার মালিকের কাছে। প্রেরকের তরফে একটা চিঠি ছিল, তাতে মালয়ালমে কয়েকটা বাছাবাছা গাল দিয়ে লেখা ছিল, ‘‘মানিব্যাগে দু’টাকা নিয়ে বেরোতে লজ্জা করে না?’’ চিঠির সঙ্গে একটা পাঁচ টাকার নোটও পিন দিয়ে আটকানো ছিল!
সে দিনের সেই ‘ফকির কমরেড’ এখনও চাল-চুলোহীন। বয়সের ছাপ পড়েছে চেহারায়, তবে দু’কানের পাশ দিয়ে এখনও চুলের ধারা বহমান। এই পান্নিয়ান রবীন্দ্রনই এ বার ভাবিয়ে তুলেছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রাক্তন বড় কর্তাকে!
সিপিআইয়ের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক রবীন্দ্রন এ বার তিরুঅনন্তপুরম লোকসভা কেন্দ্রে এলডিএফ প্রার্থী। এই কেন্দ্র থেকেই ২০০৫ সালে লোকসভা উপনির্বাচনে জিতেছিলেন। কিন্তু সমুদ্র উপকূলবর্তী এই কেন্দ্রের গত তিন বারের কংগ্রেস সাংসদ এখন প্রশ্ন তুলছেন, ‘‘ওয়েনাড়ে রাহুল গান্ধীর প্রার্থী হওয়া নিয়ে এত কথা বলে সিপিআই এখানে আমার বিরুদ্ধে লড়ছে কেন? ওরা কি বিজেপিকে সাহায্য করতে চায়?’’ পরিস্থিতি এমনই যে, অভিনেতা প্রকাশ রাজ বেঙ্গালুরু থেকে তিরুঅনন্তপুরমে এসে বলে গিয়েছেন, কংগ্রেসের নামী সাংসদের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়ে সিপিআই ঠিক করেনি!
তিরুঅনন্তপুরমে সিপিআই বরাবরই লড়ে। রবীন্দ্রন যে কারণে বলছেন, ‘‘ঐতিহাসিক ভাবে আমরা এখানে লড়াই করে আসছি। বিজেপিকে হারানোর মূল লক্ষ্য নিয়েই এ বার ফের লড়ব।’’ তা হলে কংগ্রেস প্রার্থীর উদ্বেগের কারণ কী? তার উত্তর নিহিত গত কয়েক বছরের ঘটনাপ্রবাহে। তিরুঅনন্তপুরম পুর-নিগমে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে উঠে এসেছে বিজেপি। বামেদের জোট থাকায় পুরবোর্ড গড়েছে এলডিএফ। তবে বিজেপির উত্থান চমকপ্রদ। এই লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যেই কেরলের একমাত্র বিধানসভা আসন কয়েক বছর আগে জিতেছিল বিজেপি। সেই আসন সিপিএম পুনরুদ্ধার করে নিলেও বিজেপির সংগঠন বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। আবার ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের নিরিখে দেখলে তিরুঅনন্তপুরম লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ৭টি বিধানসভা এলাকার ৫টিতেই সিপিএম জয়ী। তিরুঅনন্তপুরম বিধানসভা এলডিএফেরই শরিক জনাধিপত্য কেরল কংগ্রেসের দখলে। বাকি একটি মাত্র আসনে কংগ্রেসের বিধায়ক!
অঙ্ক বলছে, বিজেপির ভোট এখানে বেড়ে যাওয়া একেবারেই অস্বাভাবিক নয় এবং উল্টো দিকে বিজেপি-বিরোধী ভোটে রবীন্দ্রন যদি বড় করে ভাগ বসিয়ে দেন, তা হলে কংগ্রেসের রাস্তায় কাঁটা বিছিয়ে যেতেই পারে! সে কারণেই সিপিআইকে নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগছেন কংগ্রেস প্রার্থী।
কংগ্রেসের উপরে চাপ বাড়াতে বিজেপি এই কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং সর্বভারতীয় সংবাদ চ্যানেলের কর্ণধার রাজীব চন্দ্রশেখরকে। তিনি এসে নতুন মন্ত্র ঘোষণা করেছেন, ‘এ বার কাজ হবে’। যেমন, উপকূলের ধারে কিছু এলাকায় ভাঙনের সমস্যা দেখে তিনি দ্রুত কেন্দ্রীয় মন্ত্রক থেকে প্রতিনিধিদল এনে সমীক্ষা করিয়েছেন। একই বিষয়ে এর আগে তিন বার কেন্দ্রকে চিঠি দিয়েছিলেন বর্তমান সাংসদ। যে দিকে কটাক্ষে করে চন্দ্রশেখর মন্তব্য করেন, ‘‘কোনও বিষয় তুললেই সাংসদ বলেন, তিনি কত বার চিঠি লিখেছেন! শুধু চিঠি লিখলেই কি সাংসদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? মানুষ এ বার দেখবেন, কী ভাবে কাজ হয়!’’ বিজেপির প্রার্থীর দেওয়া হলফনামায় অবশ্য ৬৮০ টাকা উপার্জনের কথা লেখা আছে, যা নিয়ে দক্ষিণী রাজনীতিতে বিপুল হইচই। সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে প্রার্থী আবার প্রবল ক্ষুণ্ণ হন!
রাজ্যে ৮ বছরের বাম সরকার এবং তিরুঅনন্তপুরমে টানা ১৫ বছরের কংগ্রেস সাংসদ— এই দুইয়ে মিলে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার ফায়দা চন্দ্রশেখর নিতে চাইছেন। এই চাপের মুখে কেমন আছেন কংগ্রেস প্রার্থী? খোঁজ নিতে শহরের তুলনামূলক শান্ত এলাকায় তাঁর বাড়িতে হানা দিয়ে দেখা গেল, প্রবল গরমে প্রচারের ধকল সামলাতে বিকেলে ঘড়ি ধরে হাল্কা ঘুমে ভরসা রাখছেন সাংসদ। ‘পাওয়ার ন্যাপ’ যাকে বলে! চেহারাতেও ছাপ পড়েছে পরিশ্রমের। লড়াই এ বার কতটা কঠিন? প্রার্থী বলছেন, ‘‘বিজেপি এখানে গত দু’বার লোকসভা ভোটে দ্বিতীয় হয়েছে। তাদের সেরা বাজি এখানেই। তাই গুরুত্ব দিতেই হবে। সিপিআই প্রার্থী না থাকলে ব্যাপারটা অন্য রকম হত। তবে আশা করছি, বিজেপি ও বামের মধ্যে শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় স্থানে থাকার লড়াই হবে।’’
প্রচারের সময়ের চেনা মালয়ালি পোশাক ‘মুন্ডম’ ছেড়ে প্রাক্তন কূটনীতিককে দেখা যাচ্ছে কুর্তা ও সাধারণ ট্রাউজার্সে। রাজনৈতিক পোশাকে বার্তা দেওয়ার পাট নেই এ বার? পরের
দফার প্রচারে বেরোনোর আগে ২৫টা ‘বেস্টসেলার’ বইয়ের লেখক বলে গেলেন, ‘‘তিন বার সাংসদ হয়েছি। কর্মভূমি, শান্তিভূমি এক হয়ে গিয়েছে। নতুন আর কী বলার আছে!’’
আটপৌরে কায়দায় উদ্বেগ আড়ালে রেখেই এ বার ‘ভূমি’ আগলাতে নেমেছেন শশী তারুর!