সিদ্দারামাইয়া। — ফাইল চিত্র।
‘তোর ফ্ল্যাটে কাবেরী আসে?’ ‘না, সামনের মাস থেকে আসবে বলছে।’
‘তা হলে কাবেরী ছাড়া কী ভাবে থাকিস?’ ‘কাবেরী না এলে এই ফ্ল্যাটে আর থাকা যাবে না।’
বেঙ্গালুরুর হোয়াইটফিল্ডের ‘এসেন্স অব কলকাতা’ রেস্তরাঁয় বসে দুই বাঙালি তরুণীর কথোপকথন শুনলে মনে হবে, তাঁদের কোনও বান্ধবীকে নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কাজের ফাঁকে সল্টলেকের শর্বরী ও দুর্গাপুরের পৌলমী বাঙালি খাবার খেতে এসেছেন। কিন্তু কোনও এক কাবেরী তাঁদের চিন্তায় ফেলেছে।
না, কাবেরী তাঁদের বান্ধবী নয়। শর্বরী-পৌলমীর চিন্তা কাবেরী নদীর জল নিয়ে। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের রাজধানী বেঙ্গালুরুর জনসংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। তার অর্ধেক মানুষের চিন্তা এখন একটাই। পানীয় জল থেকে প্রতি দিনের ব্যবহারের জলের তীব্র সঙ্কট। পুরনো বেঙ্গালুরু-সহ শহরের যে সব এলাকায় কাবেরী নদীর পরিস্রুত জল পাইপে করে পৌঁছয়, সেখানে চিন্তা নেই। কিন্তু যেখানে কাবেরী নদীর জল নেই, সেখানে জলের জন্য হাহাকার।
জলের চিন্তায় শিকেয় উঠেছে কর্নাটকের ভোট নিয়ে ভাবনা। জলের সঙ্কটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে ভোটের রাজনীতিও। বিজেপি দুষছে কর্নাটকের কংগ্রেস সরকারকে। খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কর্নাটকের প্রচারে বেঙ্গালুরুতে এসে জলের সঙ্কট নিয়ে সরব হচ্ছেন। আর কংগ্রেস বলছে, বিজেপির আমলে যথেচ্ছ নগরায়ণের অনুমতি দেওয়ার ফলেই জলের অভাব। ২৬ এপ্রিল বেঙ্গালুরুর ভোটগ্রহণ। কংগ্রেস, বিজেপি দুই শিবিরই মানছে, জলের সঙ্কট ভোটের বাক্সে ছাপ ফেলবে।
বেঙ্গালুরু শহরে মধ্যরাতে রাজপথে নামলে দেখা যাবে, জলের ট্যাঙ্কারের মিছিল। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের উত্থানের সঙ্গে ২০০৭-এর পর থেকে পূর্ব বেঙ্গালুরুর হোয়াইটফিল্ডের মতো নতুন নতুন এলাকা বেঙ্গালুরু শহরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তৈরি হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার দফতর, বহুতল আবাসন। তার অধিকাংশ এলাকাতেই এখনও কাবেরী নদীর পরিস্রুত জল পৌঁছয় না। আর এইসব এলাকাতেই শর্বরী, পৌলমীদের মতো হাজারে হাজারে পশ্চিমবঙ্গ বা অন্য রাজ্য থেকে বেঙ্গালুরুতে আসা তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মীদের বাস। তাঁদের ভরসা মাটির নিচের বোরওয়েলের জল। সেই জলও পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হলে শুকিয়ে যায়। তখন জলের ট্যাঙ্কারই ভরসা।
শর্বরী শুকনো মুখে বলেন, ‘‘হোয়াইটফিল্ডের যে ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকি, সেখানে সুইমিং পুল রয়েছে দেখে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলাম। গত তিন বছরে সুইমিং পুলে জলের দেখা পাইনি। এখন জল দিয়ে গাড়ি ধুলে দশ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য হয়েছে। বোরওয়েলের জল শুকিয়ে গেলে জলের ট্যাঙ্কার থেকে ফ্ল্যাটবাড়ির উপরের ট্যাঙ্কে জল ভরা হয়। তার জন্য ফ্ল্যাট ভাড়ার সঙ্গে বাড়তি মোটা টাকা গুণে দিতে হয়।’’ তা হলে উপায়? ‘আমার শহরে শুকিয়ে যাচ্ছে জল, অন্য কোথাও চল’— দুশ্চিন্তা নিয়ে চন্দ্রবিন্দুর গান গেয়ে ওঠেন দুই বান্ধবী। উপায় একটাই। যেখানে কাবেরীর জল পৌঁছয়, সেখানে ফ্ল্যাট খুঁজতে হবে।
মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কাবেরী নদীর জল সরবরাহের নতুন প্রকল্প মে মাস থেকেই চালু হয়ে যাবে। বিজেপির অভিযোগ, কর্নাটকের উপমুখ্যমন্ত্রী ডি কে শিবকুমার তাঁর ভাই, গ্রামীণ বেঙ্গালুরুর সাংসদ ডি কে সুরেশের হয়ে প্রচারে গিয়ে হুমকি দিচ্ছেন, ভোট না দিলে জল মিলবে না। যে এলাকায় কংগ্রেস ভোট পাবে, সেখানে কাবেরীর জল পৌঁছবে। দক্ষিণ বেঙ্গালুরুর সাংসদ বিজেপির তরুণ তুর্কি তেজস্বী সূর্যের বক্তব্য, ‘‘বেঙ্গালুরুতে কাবেরী নদীই ভরসা। এ নিয়ে রাজনীতি করলে হবে না। সমাধান খুঁজতে হবে।’’ উত্তর বেঙ্গালুরুর কংগ্রেস প্রার্থী আইআইএম, বেঙ্গালুরুর প্রাক্তন অধ্যাপক রাজীব গৌড়া দায়িত্ব নিয়ে বলছেন, ‘‘বিজেপি এ নিয়ে এ তদিন কিছুই করেনি। আমি সাংসদ হলে জলের সঙ্কটের সমাধানে নেতৃত্ব দিতে তৈরি।’’
নরেন্দ্র মোদী কর্নাটকে প্রচারে এসে অভিযোগ তুলছেন, কংগ্রেস জলের ট্যাঙ্কারের কালোবাজারি করছে। তথ্যপ্রযুক্তি শহরকে জলের ট্যাঙ্কারের শহরে পরিণত করে ফেলেছে। আর কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার অভিযোগ, শুধু বেঙ্গালুরু নয়। কর্নাটকের অনেক জেলাতেই বৃষ্টির অভাবে খরা পরিস্থিতি। তবু মোদী সরকার আর্থিক সাহায্য করতে নারাজ।
উপমুখ্যমন্ত্রী ডি কে শিবকুমারের অভিযোগ, ‘‘বেঙ্গালুরুর সাত হাজার বোরওয়েল শুকিয়ে গিয়েছে। তা-ও আমরা বিকল্প জলের ব্যবস্থা করেছি। আমরা কাবেরী নদীর জল তামিলনাড়ুকে ছেড়ে দিয়েছি বলে বিজেপি মিথ্যে প্রচার করছে। জলই নেই, তো ছাড়ব কোথায়?”
শর্বরী-পৌলমীর মতো সিদ্দারামাইয়া-শিবকুমারকেও চিন্তায় ফেলে দিয়েছে ‘কাবেরী’।