প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
কোটিপতির কাছে এখন বড় সমস্যা ৬২ টাকা। মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর আসনে এই ভাবেই ব্যাখ্যা করছেন বিড়ি শিল্পের সঙ্গে যুক্তদের অনেকে। কেন?
তাঁরা বলছেন, এই কেন্দ্রে এক দিকে কোটিপতি বিড়ি শিল্পপতিদের নিজস্ব ভোট-গণিত, অন্য দিকে বিড়ি শ্রমিকদের ৬২ টাকা মজুরি না বাড়ার ক্ষোভ। প্রধানত, এই দু’টি বিষয়কে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে নির্বাচনের প্রচার। যদিও লক্ষ্মীর ভান্ডারকেও বাদ দিচ্ছেন না তাঁরা। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতেও, বিড়ি মহল্লায় ছাপ ফেলতে পারে রাজ্যের এই প্রকল্পও। পরিসংখ্যানও বলছেন, জঙ্গিপুরের প্রায় ৮ লক্ষ বিড়ি শ্রমিকের ৮০ শতাংশই মহিলা। ১৮.০১ লক্ষ ভোটারের মধ্যে জঙ্গিপুরে মহিলা ভোটারের সংখ্যা ৮.৮৬ লক্ষ। এ বারে জঙ্গিপুরে কংগ্রেস ও তৃণমূল, মূল দুই প্রতিপক্ষের সব সভাতেই এই কড়া রোদেও মহিলাদের বেশ ভিড়ও হচ্ছে।
রাজনৈতিক পর্যেক্ষকেরা আরও বলছেন, জঙ্গিপুরে তৃণমূলের প্রার্থী, কোটিপতি খলিলুর রহমানকে তাঁর দলেরই সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্যের জের সামলাতে হচ্ছে। সাগরদিঘি উপনির্বাচনের সময়ে প্রচারে এসে অভিষেক বলেছিলেন, বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে হবে। সে দায়িত্ব তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন খলিলুর ও আর এক কোটিপতি বিড়ি শিল্পপতি, তৃণমূলের বিধায়ক জাকির হোসেনকে। কিন্তু তার পরেও বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। সেই ক্ষোভ লোকসভা ভোটের আগে গোটা মহল্লায় গরম হাওয়ার মতোই ঘুরছে। ভোটের আগে ২৪ এপ্রিল রঘুনাথগঞ্জে প্রচারে এসেও অভিষেক বিড়ি নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। খলিলুরের অবশ্য বক্তব্য, “বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে আমি মালিক সংগঠনকে চিঠি দিয়েছি। তারা শ্রমিক সংগঠনগুলির সঙ্গে আলোচনাও চালাচ্ছে।”
মজুরি কিন্তু তাতে বাড়েনি। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও নানা ধরনের সমীকরণ। খলিলুরের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন খোদ বাইরন বিশ্বাসের বাবা, কোটিপতি বিড়ি শিল্পপতি বাবর বিশ্বাস এবং তৃণমূলেরই সুতির বিধায়ক ইমানি বিশ্বাসের দাদা সাজাহান বিশ্বাস। সাজাহানও বিড়ি শিল্পপতি। এবং কোটিপতি। বাবর দাঁড়িয়েছেন তাঁর ভাগ্নে আসাদুল শেখের পাশে। আসাদুল নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছেন এই কেন্দ্রে। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, আসাদুল যে বিরাট কনভয় নিয়ে মনোনয়ন জমা দিতে গিয়েছিলেন, তার পিছনে ছিল বাবরের টাকা। বাইরন অবশ্য বলেছেন, ‘‘বাবাকে বহু বার অনুরোধ করেছি এ সব না করতে। কিন্তু কথা শোনেননি। হাজার পাঁচেক ভোট পেতেই পারেন ভাই। সেটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।’’ কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, খলিলুরের উপরে আস্থা সরে যাওয়াতেই কি বাবর এমন করছেন?
আবার, ইমানির দাদা সাজাহান বিশ্বাস দাঁড়িয়েছেন আইএসএফের প্রতীকে। ইমানির বক্তব্য, ‘‘দাদার সঙ্গে রাজনৈতিক মতের মিল নেই। তিনি আলাদা থাকেন।’’ কিন্তু তাতেই বিবাদ কমছে না। খোদ ইমানির বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে। ইমানি দাবি করেছিলেন, ‘‘লোকসভায় দলের প্রার্থীকে অন্তত ১৫ হাজার ভোটের লিড দেব সুতি থেকে।” তা শুনে তৃণমূলের জঙ্গিপুরের এক জেলা কমিটির সহ-সভাপতি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘২০১৯ সালে সুতিতে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের ব্যবধান ছিল ৬৪ হাজার। ২০২১ সালে বিধানসভায় ইমানি সুতিতে জেতেন ৭০ হাজারেরও বেশি ভোটে। তা হলে এ বারে মাত্র ১৫ হাজার লিড?’’ সাজাহানের হয়ে নওসাদ সিদ্দিকী প্রচার করেছেন। তবে আইএসএফের তেমন কোনও সংগঠনই নেই জঙ্গিপুরে।
লড়াই কিন্তু ‘দেবেন’ কংগ্রেস প্রার্থী মুর্তজা হোসেনও। রাজনীতি তাঁর পরিবারে। মুর্তজা এত দিন লড়েছেন পঞ্চায়েত স্তরে। এ বারে মুর্তজার পক্ষে যাচ্ছে কংগ্রেস ও সিপিএমের জোট। যদিও জোট সর্বত্র সমান ভাবে কাজ করছে, এমনও নয়। ‘সাগরদিঘি মডেল’ খাস সাগরদিঘিতেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। সাগরদিঘি জুড়ে তৃণমূল যখন দাপিয়ে ভোট প্রচার করছে, তখনও রাস্তায় সে ভাবে নেই কংগ্রেসের এক জন কর্মীও। পোস্টারও নেই। বিরোধী বলতে ব্লকে মূলত বাইরনের ভাই নির্দল আসাদুলের প্রচার পোস্টার।
আসনটি ধরে রাখতে সামগ্রিক ভাবে কতটা চিন্তিত জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব? দলের রাজ্য সহ-সভাপতি প্রাক্তন বিধায়ক মইনুল হক বলছিলেন, “শুনতে পাচ্ছি, দলের মধ্যেই কেউ কেউ বলছেন, খড়গ্রামে ভোট ভাল হবে না খলিলুরের। কেউ বলছেন সাগরদিঘিতে ভাল হবে না, লালগোলায় ভাল হবে না। তা হলে ভালটা কোথায় হবে? ৭টি বিধানসভা নিয়ে জঙ্গিপুর। ৭টিতেই আমাদের দলের বিধায়ক।’’ তাঁর উদ্বেগ চাপা থাকছেন না, ‘‘জঙ্গিপুরে কোনও কারণে যদি হেরে যাই, তা হলে মুখ দেখাতে পারব না!”
তবে বিজেপিকে তেমন একটা ভয় তৃণমূল পাচ্ছে না। ২০১৯ সালের নির্বাচনে ৩.১৭ লক্ষ ভোট পেয়ে জঙ্গিপুরে দ্বিতীয় স্থানে ছিল বিজেপি। এ বারে বিজেপি সংখ্যালঘু মুখ মাফুজা খাতুনকে সরিয়ে প্রার্থী করেছে উত্তর মুর্শিদাবাদের সভাপতি ধনঞ্জয় ঘোষকে। তৃণমূল প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্ট, জেলার সহ-সভাপতি বিকাশ নন্দ বলছেন, “ধনঞ্জয়বাবুর স্ত্রী-সহ সুতি ১ ব্লকের তিন বিজেপি সদস্য পঞ্চায়েত সমিতির বোর্ড গড়তে তৃণমূলকে সমর্থন করেছেন। বিজেপি এ বারে সে ভাবে লড়াইয়ে নেই।” তৃণমূলের আশঙ্কা, বিজেপির সেই ভোটের গতিপথ নিয়ে। ধনঞ্জয়বাবু অবশ্য বলছেন, “পঞ্চায়েত আর লোকসভা ভোট এক নয়। তাই মোদী হাওয়ায় গত বারের চেয়ে অন্তত দু’লক্ষ ভোট বেশি পাবে বিজেপি।”
এই পরিস্থিতিতে কার্যত দৌড়চ্ছেন খলিলুর। তাঁকে জেতাতে যে বিধানসভা ও অঞ্চল সব চেয়ে বেশি লিড দেবে, তাদের পুরস্কার দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছেন তিনি। খলিলুর এবং মুর্তজা দু’জনেরই ভাবমূর্তি স্বচ্ছ। তবে মুর্তজা বলছেন, “খলিলুর ভাল মানুষ বলে শুনি। প্রশ্ন তাঁর দলের ভূমিকা নিয়ে। সিএএ বিল যে দিন সংসদে উঠল, সে দিন তিনি সংসদে অনুপস্থিত কেন? কেন সাগরদিঘির উপনির্বাচনে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি ১৭৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক মাসের মধ্যে ২৪০ টাকা করার আশ্বাস দেওয়ার পরেও কাজের কাজ কিছু হল না? উত্তরটা তো তাঁদেরই দিতে হবে।”
খলিলুরের জবাব, “যে দিন সংসদে সিএএ বিল ওঠে, সে দিন আমার দিদি মারা যান। তাই জানাজায় অংশ নিতে চলে যেতে হয়েছিল আমায়। আর বিড়ি মালিকদের সঙ্গেও কথা বলেছি।” কিন্তু সে যুক্তি বিড়ি শ্রমিকেরা মেনে নিচ্ছেন কি না, জানা যাবে ৪ জুন।