—প্রতীকী ছবি।
ভোটের সভায় গান ধরেছেন বিজেপির ‘কবিয়াল’ প্রার্থী। ভক্তিরসের সুর মাখিয়ে সে গানের কলিতে-কলিতে সন্দেশখালি থেকে নিয়োগ দুর্নীতি উগরে দিচ্ছেন তিনি (তখনও অবশ্য সন্দেশখালি নিয়ে তৃণমূলের ‘স্টিং ভিডিয়ো’ প্রকাশ্যে আসেনি)। সভায় জড়ো হওয়া দলীয় সমর্থকেরা শুধু নন, পথচলতি মানুষজনও দাঁড়িয়ে শুনছেন সেই গান। গানের মাঝে মাঝে নিজস্ব ভঙ্গিতেই টিটকিরি, রসিকতা ছুড়ে দিচ্ছেন অসীম সরকার। হরিণঘাটার পদ্ম বিধায়ক, আপাতত যাঁকে বর্ধমান-পূর্ব লোকসভা কেন্দ্রের লড়াইয়ে নামতে হয়েছে।
ভোটের ফলাফলের বিচারে তৃণমূলের খাসতালুক বর্ধমান-পূর্ব লোকসভা কেন্দ্র। ২০২১ সালের বিধানসভায় এই লোকসভায় সাতে-সাত পেয়েছে রাজ্যের শাসক দল। তাই অচেনা মাঠে খেলতে এসে নিজের ‘চেনা পরিচয়’কেই হাতিয়ার করছেন বিজেপির কবিয়াল-প্রার্থী। এই তল্লাটে মতুয়া ভোটব্যাঙ্কের উপরেও গেরুয়া শিবিরের ভরসা আছে। তার উপরে কালনা, পূর্বস্থলী, কাটোয়া জুড়ে অসীমের ‘পূর্বাশ্রমের’ পরিচিতিও যথেষ্ট। এলাকার বহু কবিগানের সভা মাতিয়েছেন তিনি। তখনও বিধায়ক-নেতা হননি। ভোট প্রচারের ফাঁকে ফাঁকে জনসংযোগে সে সব স্মৃতি উস্কে দিচ্ছেন তিনি। মানুষও সাড়া দিচ্ছেন তাতে। সেই সাড়াতেই এ বার পালাবদলের খোয়াব দেখছেন অসীম। এলাকার বিজেপি নেতাদেরও আশা, এই মাঠে পদ্ম ফুটবেই।
আশাতেই তো চাষা বাঁচে! রাজ্যের কৃষিক্ষেত্রের বৃহত্তম শরিক, বর্ধমানের এই তল্লাটেও তাই বিজেপির প্রার্থী কিংবা সমর্থকেরা আশা জিইয়ে রাখবেন না, এমন তো নয়। সে যতই বিধানসভা ভোটের হিসাব কিংবা বিজেপির সাংগঠনিক দুর্বলতা অন্য কথা বলুক।
তবে শুধু আশা নয়, আশঙ্কারও ফল্গুধারা বইছে। ভোট প্রচারের ফাঁকে একান্ত আলাপে সে সব নিয়ে মুখ খুলছেন তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের অনেকেই। তাঁরা বলছেন, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কাঁটা আছে। তা থেকে রক্তপাতও হতে পারে। তেমন হলে পাশা উল্টে যাওয়াও অসম্ভব নয়। তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের অসুখ অবশ্য নতুন নয়। ভোটের আগে মলম লাগিয়ে কেল্লা ফতে করার উদাহরণও আছে। তবে চিন্তার বিষয়, এ বার তা অনেকখানি ছড়িয়েছে। রায়নায় যেমন বিধায়ক বনাম এক ব্লক সভাপতির ‘দ্বন্দ্বে’ কোনও আড়াল নেই। দু’পক্ষই
বছরভর একে অন্যের বিরুদ্ধে তাল ঠোকে। মেমারিতেও শাসক দলের কলহ ‘সুবিদিত’।
এ দিকে, কাটোয়ার বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ‘সজ্জন’ হিসেবে পরিচিত। একদা কংগ্রেসের পোড়খাওয়া নেতা রবীন্দ্রনাথ তৃণমূলে এসেও প্রভাব বজায় রেখেছেন। তবে নিন্দুকেরা বলেন, প্রতিবেশী এক বিধায়কের অনুগামীদের সঙ্গে বিধায়কের সম্পর্ক মোটেও মধুর নয়। দুই বিধায়কের গোষ্ঠীর বিবাদও স্থানীয় রাজনীতিতে সুবিদিত। পুরভোটে সে সব নিয়ে বিস্তর গোলমাল হয়েছিল। সেই সব বিবাদের ধাক্কা লোকসভা ভোটে পড়বে কি না, তা নিয়েও চর্চা চলছে রাজনৈতিক মহলে। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য সে সব পাত্তা দিচ্ছেন না। বলছেন, ‘‘আমার বিধানসভা থেকে দল লিড পাবেই।’’
কাঁটার মতো বিঁধছে গত বছরের পঞ্চায়েত ভোট। তা নিয়ে রীতিমতো হাত কামড়াচ্ছিলেন শাসক দলের এক রাজ্য স্তরের নেতা। বলছিলেন, ‘‘ও সব না করলেই ভাল হত। অন্তত ভোটের হিসাবটুকু হাতে থাকত। এখন তো বিধানসভা ভোটের হিসাব ধরে এগোতে হচ্ছে। কিন্তু তিন বছরে গঙ্গা দিয়ে কম জল তো গড়ায়নি।’’ কালনার মতো কিছু এলাকায় বিজেপির পালে হাওয়াও আছে।
রাজনৈতিক মহলের খবর, এ সব বিবাদ পাশ কাটাতেই লোকসভায় তৃণমূল প্রার্থী করেছে চিকিৎসক শর্মিলা সরকারকে। তাঁর প্রচার, ভোট পরিকল্পনা এ সব একেবারেই দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে দলের শীর্ষ স্তর। শর্মিলাও রাজনীতির ময়দানে খাটছেন। দলের অন্দরের কলহ তাঁকে বিপাকে ফেলবে কি? কোন্দলের কথা অজ্ঞাত নয় শর্মিলার। তিনি বলছেন, ‘‘বড় দলে অনেক ব্যক্তিগত ব্যাপার থাকে। তবে ভোটের ময়দানে সবাই নিজের মতো করে ঝাঁপিয়েছেন। জয় নিয়ে ১০০ শতাংশ নিশ্চিত আমি।’’
ভোটে লড়ছেন সিপিএমের প্রার্থী, শিক্ষক নীরব খাঁ-ও। প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠনের এই নেতার প্রচারেও উঠে আসছে রাজ্যের নানা দুর্নীতির প্রশ্ন। বিজেপির নির্বাচনী বন্ড নিয়েও সরব তিনি। উপরন্তু, এ বার ভোটে বাম নেতাদের মনে আশা জুগিয়েছে পঞ্চায়েতে রায়না-সহ বিভিন্ন এলাকায় সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি। রায়নায় দলীয় অফিসে বসে বর্ধমানের কয়েক জন বাম নেতা বলছিলেন, ভোটারদের একটা অংশ বিজেপির দিকে ঝুঁকেছিল। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটে সেই ভোট ফিরেছে। সে কথা মাথায় রেখেই স্থানীয় স্তরে কৃষি এবং কৃষকের সমস্যার কথাও তুলছেন তাঁরা। ফড়েদের দাপট, ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার কথাও বলছেন। বামেদের আশা, লোকসভায় আরও ভোট বাড়বে তাদের।
বামেদের এই ভোট ফেরা নিয়ে আশাবাদী তৃণমূল নেতারাও। অঙ্ক কষে তাঁরা দেখাচ্ছেন, ২০১৪ সাল থেকেই এই কেন্দ্রে বামেদের ভোট যে হারে কমেছে, কার্যত সে হারেই বেড়েছে বিজেপির ভোট। ২০১৯-এর হিসাবে তৃণমূল এবং বিজেপির ভোটের ফারাক ৬ শতাংশ। তাই বামেরা যদি ভোট ফেরাতে পারে, তা হলেই পদ্মকাঁটা অনেকটা মসৃণ হয়ে যাবে।
রাজনীতির এই আঁক কষাকষির থেকে তফাতে আরও কিছু বিষয় থাকে। সেই সমস্যা অবশ্য নেহাতই ভোটারদের। বর্ধমান-পূর্ব লোকসভায় যেমন গঙ্গার ভাঙনের সমস্যা আছে, পূর্বস্থলীতে পানীয় জলে আর্সেনিকের সমস্যা আছে, ক্ষয়িষ্ণু তাঁত শিল্পের শরীরে বাসা বাধা ব্যাধি আছে। সে সব কথা অবশ্য এই লোকসভা কেন্দ্রের ভোটে তেমন ভাবে শোনা যাচ্ছে না।
প্রবল গরমে রোদে দাঁড়ানো ভোটারের ভোট দুর্মূল্য। ভোটারের সমস্যার অবশ্য…।