Lok Sabha Election 2024

কে কাকে দুষবেন, প্রচারে নেই লজ্জার স্মারক-ব্রিজ

উন্নয়নের বহর অবশ্য এই এলাকায় আসার পথেই চোখে পড়েছে। সাত নদী ঘিরে রেখেছে খগড়িয়ার ভূখণ্ডকে। পথে বুড়ি গণ্ডক নদী পেরোতেই চোখে পড়ে নবনির্মিত আর একটি ব্রিজ।

Advertisement

অঞ্জন সাহা

খগড়িয়া শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২৪ ০৭:১০
Share:

খগড়িয়া সুলতানগঞ্জের সেই ভেঙে পড়া সেতু। — নিজস্ব চিত্র।

‘‘গঙ্গায় স্নান সেরে মোবাইলটা সবে হাতে নিয়েছি, প্রথমে অদ্ভুত একটা আওয়াজ। মুহূর্তে খসে পডল ব্রিজের একটা অংশ। গঙ্গায় সেটা পড়তেই অনেক উঁচু পর্যন্ত ছলকে উঠল জল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পুলটার অন্য দিকটাও ভেঙে পড়ল— একেবারে তলিয়ে গেল জলের ভিতরে...।’’

Advertisement

খগড়িয়ার আগুয়ানি ঘাটের কাছে দাঁড়িয়ে এক নিঃশ্বাসে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন বছর বাইশের অজয় কুমার। বিকেল হয়ে গিয়েছে। সারাদিনের প্রচণ্ড গরমের পরে এই জায়গায় অজয়ের মতো আরও কয়েক জন যুবক, কিশোর জড়ো হয়েছেন। পাশে ভুট্টার খেতে এখন সোনালি আলো। সেখানে পাতালতা আর কালো প্লাস্টিকে মোড়া ছাউনির বাইরে দাঁড়িয়ে কয়েক জন মহিলা। তাঁরাও এসে শুনছেন অজয়ের কথা। আর ওঁদের সকলের পিছনে নির্মীয়মাণ অতিকায় ব্রিজের টানা লম্বা অংশ।

খগড়িয়া থেকে সুলতানগঞ্জ— ভাগলপুরের মধ্যে এই সেই চার লেনের বিখ্যাত ব্রিজ, যা তৈরি হওয়ার সময়েই দু’বার বার ভেঙে গিয়ে সারা দেশের সামনে লজ্জার এক স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গত বছর জুনের ৪ তারিখে, নির্মীয়মাণ ব্রিজটির ভেঙে পড়ার কথা শোনাচ্ছিলেন খগড়িয়ার বিঠলার বাসিন্দা অজয়। তার আগেও অবশ্য ১৩ এপ্রিল এই ব্রিজেরই অন্য অংশ ভেঙে পড়েছিল। ২০১৪ সালে তৈরি হতে শুরু করেছিল যে ব্রিজ, ২০১৯-এর নির্ধারিত সময়ে তা শেষ হয়নি। গত দশ বছর ধরে নির্মাণ ও ধ্বংসের খেলা খেলতে খেলতে সতেরোশো কোটি টাকারও বেশি বাজেটের ব্রিজ নেতা-মন্ত্রী-প্রশাসকদের সামনে প্রশ্নচিহ্ন হয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে।

Advertisement

এই নির্মীয়মাণ প্রকল্পে মাটি ভরার কাজ করেন স্থানীয় যুবক অজয়। রোজের কাজের উপর পয়সা মেলে। প্রকল্প শেষ না হওয়ায় তাঁর হাতে কাজ রয়ে গিয়েছে। বলেন, ‘‘এখন নদী পেরিয়ে নৌকা করে ভাগলপুরে যেতে হয়। বাড়ি থেকে ঘাটে পৌঁছে তারপর তো নৌকা মিলবে। পয়সা অনেক বেরিয়ে যায়। ব্রিজটা যদি তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেত!’’

উন্নয়নের বহর অবশ্য এই এলাকায় আসার পথেই চোখে পড়েছে। সাত নদী ঘিরে রেখেছে খগড়িয়ার ভূখণ্ডকে। পথে বুড়ি গণ্ডক নদী পেরোতেই চোখে পড়ে নবনির্মিত আর একটি ব্রিজ। নির্মাণের ত্রুটির জন্য সেটিরও একটি অংশ বসে গিয়েছে। আপাতত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সেতুটি। পাশে থাকা পুরনো ব্রিজটি মানুষ ও যানবাহনের যাতায়াতকে সামাল দিচ্ছে।

খগড়িয়ার ব্রিজ ভেঙে পড়ার ঘটনা নিয়ে কড়া অবস্থান নিয়েছে পটনা হাই কোর্ট। আদালত বলেছে, এটা নির্মাণ সংস্থা আর রাজ্য সরকারের গাফিলতির একটা জ্বলন্ত উদাহরণ। এ খবরও সামনে এসেছে যে, ব্রিজ নির্মাতা সংস্থা দেশের রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে এক দিনে ৭৫ লক্ষ টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনেছে।

কিন্তু খগড়িয়া লোকসভা কেন্দ্রের ভোটের প্রচারে সে সব নিয়ে কারও বিশেষ হেলদোল নেই। আর তার মধ্যেও লুকিয়ে রয়েছে রাজনীতির অঙ্ক। অনেকেই বলছেন, ব্রিজ যখন ভেঙে পড়ে, তখন মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের পাশে দাঁড়িয়ে সরকার চালাচ্ছিলেন তেজস্বী যাদব। এখন তাঁরাই দুই বিপরীত শিবিরে দাঁড়িয়ে। কে আর কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবেন?

খগড়িয়ায় লোকসভা কেন্দ্রের ভোটের লড়াইয়ে এই দু’টি দল অবশ্য সরাসরি লড়াই করছে না। এখানে বিজেপি-বিরোধী মহাজোটের হয়ে লড়ছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সঞ্জয় কুমার সিংহ। সিপিআই, সিপিআই (এমএল) লিবারেশন-এর মতো বামপন্থী দলগুলি ছাড়াও আরজেডি, কংগ্রেস জোট বেঁধে নেমেছে মহাজোটের প্রার্থীকে জেতাতে। ফলে সিপিএম কর্মীদের মধ্যে উৎসাহ তুঙ্গে। সেই উৎসাহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন খগড়িয়ায় এনডিএ-র বিদায়ী সাংসদ মেহবুব আলি কৈসর। লোকজনশক্তি পার্টির নেতা কৈসর ২০১৪ সাল থেকে দু’বার এই আসনে জয়ী হলেও এ বার টিকিট পাননি। রাতারাতি যোগ দিয়েছেন আরজেডিতে। জানিয়ে দিয়েছেন, এ বার মহাজোটের প্রার্থীকেই সমর্থন করবেন।

সিপিএমের বিপরীতে এনডিএ-র প্রার্থী চিরাগ পাসোয়ানের লোক জনশক্তির নেতা রাজেশ বর্মা। পেশায় স্বর্ণ ব্যবসায়ী রাজেশ ২০২০ সালে ভাগলপুরে বিধানসভা ভোটে দাঁড়িয়ে হেরে গিয়েছিলেন। এ বার খগড়িয়ার ভোটের মাঠে তিনি নতুন প্রার্থী। আবার বিহার থেকে জয়ী এনডিএ-র একমাত্র মুসলিম সাংসদ কৈসর পাশ থেকে সরে যাওয়ায় এখানে অনেকটাই চাপের মধ্যে রয়েছে চিরাগের দল।

খগড়িয়ায় প্রায় ২ লক্ষ ২৫ হাজার মুসলিম ভোটার, সাড়ে তিন লক্ষ যাদবের বসবাস, মাল্লা আর কুশওয়াহা ভোটার প্রায় দুই লক্ষ করে রয়েছেন। এ ছাড়া, দেড় লক্ষ কুর্মি, উচ্চবর্ণের ভোটারেরা রয়েছেন। ভোট রাজনীতিতে জাতপাতের অঙ্ক মেলাতে ব্যস্ত দুই শিবিরই।

আর এই সব কিছুর থেকে দূরে, উন্নয়নের নামে কলঙ্ক হয়ে গঙ্গার ঘাটের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে অতিকায় একটি নির্মাণ। যার বাকি অংশ শয্যা নিয়েছে নদীর অতল জলে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement