Lok Sabha Election 2024

ভোটে বার্লাই জিতবে, বলে হাসছেন জন

এই কেন্দ্রের এক দিকে ভুটান পাহাড়, অন্য দিকে অসম সীমানা। এই ভুটান পাহাড়েই এক সময় ঘাঁটি গেড়ে জঙ্গি কার্যকলাপ চালিয়েছিলেন জীবন সিংহ এবং তাঁর সাধের কেএলও।

Advertisement

সৌমিত্র কুণ্ডু

আলিপুরদুয়ার শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:০৭
Share:

জন বার্লা। — ফাইল চিত্র।

চা বাগানের সবুজ গালিচা বিছানো। জয়ন্তী, রায়মাটাং পাহাড় ছবির মতো দেখায় বাগানের প্রান্তরে। কমলালেবুর মরসুমে আরও রং খোলে। লোকসভা ভোটের গরমে অবশ্য কমলা নেই। কমলার কাছাকাছি রঙের পতাকাও ছিল না নাগরাকাটায় লক্ষ্মীপাড়া চা বাগানে। সেখানেই সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের বিদায়ী কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী জন বার্লার বাড়ি। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত সে তল্লাটে বিজেপির পতাকা-ফেস্টুন ছিল না! ভোটের ১০ দিন আগে পর্যন্ত বিজেপি প্রার্থীর হয়ে প্রচারে ছিলেন না বার্লা। উল্টে, তাঁর বাড়ির কাছে, গাছে গাছে সার বেঁধে লাগানো তৃণমূলের ঝান্ডা!

Advertisement

তবু বার্লা ছিলেন। যাবতীয় ক্ষোভ, অভিমান নিয়েই। দাবিও করেছিলেন, ভোটে তিনিই জিতবেন। তার পরে বিজেপির প্রার্থী মনোজ টিগ্গা যান তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। ডুয়ার্সের চা বাগানে হাওয়া ঘোরে। হাসিমুখে বার্লাকে দেখা যায় মনোজের পাশে, প্রচারে। প্রশ্ন ওঠে, কোন মন্ত্রে হাওয়া ঘুরল?

এই কেন্দ্রের এক দিকে ভুটান পাহাড়, অন্য দিকে অসম সীমানা। এই ভুটান পাহাড়েই এক সময় ঘাঁটি গেড়ে জঙ্গি কার্যকলাপ চালিয়েছিলেন জীবন সিংহ এবং তাঁর সাধের কেএলও। ২০০৩ সালে অপারেশন ফ্লাশ আউটে সেই জঙ্গিঘাঁটি ভেঙে যায়। জঙ্গিরা ধীরে ধীরে আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন। জীবনও সম্প্রতি আত্মসমর্পণ করেছেন।

Advertisement

এখনও জীবনের বাড়ির এলাকা, আলিপুরদুয়ারের উত্তর হলদিবাড়ি গ্রামে দাঁড়ালে ভুটানের পাহাড় দেখা যায়। সে দেশের কমলা, শীতবস্ত্র বিক্রি করতে রাঙামাটি রোড ধরে ১১-১২ কিলোমিটার পেরিয়ে কালচিনি বাজারে আসেন ব্যবসায়ী মহিলারা। আবার সেখানেই লুকিয়ে রয়েছে চা শ্রমিকদের জীবনের দুর্দশার ইতিহাসও। বাগানে অ্যাম্বুল্যান্সের অভাবে শ্রমিক-মৃত্যু বা হাসপাতালের পথে অন্তঃসত্ত্বার প্রসব হয়ে যাওয়ার কাহিনি। এখনও বন্ধ থাকা বাগানে ভারতী বিশ্বকর্মা, বিনিতা লামাদের জবাব, ‘‘কী আর বলব!’’ জমিতে চাষ করার ফাঁকে কুমারগ্রামের দক্ষিণ নারারথলির সুশীল বর্মণ বলেন, ‘‘অনেক ভোটই পার করেছি। এ বার লড়াইটা যেন কেমন দেখছি।’’

এই কেন্দ্রের তৃণমূলের প্রার্থী কুমারগ্রামের নিউল্যান্ডস চা বাগানের বাসিন্দা প্রকাশ চিক বরাইক। প্রকাশকে দল রাজ্যসভায় পাঠিয়েছে সম্প্রতি। ২০২৩-এর পঞ্চায়েত ভোট (অধিকাংশ তৃণমূলের দখলে) বাদ দিলে, গত লোকসভা এবং বিধানসভা ভোটে আলিপুরদুয়ারের সব ক’টি কেন্দ্রেই ছিল বিজেপির জয়জয়কার। বিধানসভা ভোটে জিতে অবশ্য দলবদল করেন আলিপুরদুয়ার কেন্দ্রের বিধায়ক সুমন কাঞ্জিলাল, যাঁকে ভোটের মুখে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান করা হল। বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী আরএসপির মিলি ওরাওঁ। কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের যৌথ প্রচার কার্যত নেই। প্রচারেও গোনা কিছু লোক। তার পরেও প্রকাশের লড়াই শক্ত বলেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা।

প্রকাশ এত দিন আশায় ছিলেন, কারণ বার্লার বেঁকে বসা। গত লোকসভা ভোটে বার্লা প্রায় আড়াই লক্ষ ভোটে জিতেছিলেন। এ বারে টিকিট না পেয়ে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর গোসা হয়। বিভিন্ন জায়গায় তিনি দলের বিরুদ্ধে ক্ষোভও উগরে দিতে থাকেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, মনোজ-সহ বিধায়ক ও নেতাদের একাংশ ভুল রিপোর্ট দিয়েছেনরাজ্য নেতৃত্বকে, ‘জন দাঁড়ালে নাকি গো-হারা হারবেন’! তাঁর ক্ষোভ, চা বাগানে তাঁর ‘প্রাসাদের মতো’ বাড়ি তৈরি নিয়েও দলের কান ভারী করেছেন কিছু নেতা। তবে বিজেপির একাংশের দাবি, যে সব কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার অধিকাংশই করতে পারেননি বার্লা। তার উপরে বিধানসভা ভোটের পরেই রাজ্যভাগের কথা শোনা গিয়েছিল তাঁর মুখে।

টিকিট না-পেয়ে মনোজের বিরুদ্ধে জন বার্লার নানা অভিযোগের ‘ভিডিয়ো’ (সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার) কৌশলে প্রচার করছে বিরোধী তৃণমূল। বার্লা শেষ বেলায় দলের প্রার্থীর হয়ে প্রচারে নামলেও মনোজের বিরুদ্ধে বলা তাঁর কথা ছড়িয়ে দেওয়াহচ্ছে সর্বত্র। আরও একটি কাঁটা আছে বিজেপির। ২০১৯ সালে বিজেপিকে জেতানোর অন্যতম কারিগর গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা দল বদলে এখন তৃণমূলে। দলের জেলা চেয়ারম্যান গঙ্গাপ্রসাদ ভোট পরিচালনার দায়িত্বেও। প্রকাশের কথায়, ‘‘২০১৯ সালের থেকে এখন বাগানের পরিস্থিতি আলাদা। রাজ্যের তরফে বাগানের মানুষকে পাট্টা দেওয়া হচ্ছে। বাড়ি তৈরির টাকা দেওয়া হচ্ছে। একশো দিনের কাজের টাকা মুখ্যমন্ত্রী দিচ্ছেন। মহিলারা লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা পাচ্ছেন। মানুষ বুঝছেন।’’

আলিপুরদুয়ার কেন্দ্রটি চা এবং কৃষি বলয় নিয়ে গঠিত। ১১৬টি চা বাগান রয়েছে। ভোটার পাঁচ লক্ষাধিক। ফালাকাটা,তুফানগঞ্জ, আলিপুরদুয়ার এবং কুমারগ্রামের একটা অংশ কৃষি প্রধান। বিজেপি, তৃণমূলের লক্ষ্য, এই কেন্দ্রে চা বাগানের ৪০ শতাংশের কাছাকাছি আদিবাসী ভোট, কৃষি বলয়ে ২৭ শতাংশের কাছাকাছি রাজবংশী-সহ তফসিলি ভোট নিজেদের দিকে টানা। সংখ্যালঘু ভোট ৭ শতাংশের মতো, যার অনেকটাই তৃণমূলের দখলে। সাম্প্রতিক ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের দেখতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছেন, সভা করছেন।

বাগানে এখন সেয়ানে সেয়ানে টক্কর রাজ্যের শাসক দল প্রভাবিত শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি এবং বিজেপির সঙ্গে থাকা ‘ভারতীয় টি ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’ (বিটিডব্লিউইউ)-এর। চা বলয়ে ঘুরে, বন্ধ বাগানের শ্রমিকদের মনোজ বোঝাচ্ছেন, ‘‘যে রেশন পাচ্ছেন,তা কেন্দ্রের। পাট্টা নয়, আমরা চা বাগানে জমির অধিকার চাইছি। ন্যূনতম মজুরি চাই। এটা কেন্দ্রের ভোট। তৃণমূলকে ভোট দিলে, ভোট নষ্ট করা হবে।’’

বাগানের মহিলা, শ্রমিকদের একাংশ বলছেন, ‘‘লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা পাচ্ছি। এতে কী হয়? চাল-রেশন যে জোগাবে, বাগানের ভোট তার।’’ যদিও তার পরেও গত বারের জয়ের ব্যবধান এ বার ধরে রাখা ‘কঠিন’, মত দলের একাংশের।

সেখানে হাজার অভিযোগের পরেও যিনি তুরুপের তাস হতে পারেন, সেই জন বার্লা যেমন প্রচারে বেরোতে শুরু করেছেন, তেমন আবার বাড়িতে তাঁর অন্য মেজাজ। বলছেন, ‘‘দলের সঙ্গে আছি, থাকব। এটা বলতে পারি, জন বার্লাই জিতবে।’’ সোফায় বসে হাসছেন তিনি। ইঙ্গিতপূর্ণ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement