কে চন্দ্রশেখর রাও। —ফাইল চিত্র।
জেতা তো দূরে থাক, আপাতত রাজ্য রাজনীতিতে ভেসে থাকার লক্ষ্যেই চলতি নির্বাচনে তেলেঙ্গনায় মাঠে নেমেছেন কে চন্দ্রশেখর রাও-এর দল ভারত রাষ্ট্র সমিতি (বিআরএস)
পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের শাসনের পর, বিশেষত প্রবল জনসমর্থন নিয়ে ২০০৬ সালে ক্ষমতায় ফেরার পরও বামেরা ধুয়েমুছে গিয়েছিল, পাঁচ বছর পরে। হেরে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ঠিক একই দশা কে চন্দ্রশেখর রাও (জাতীয় রাজনীতিতে যিনি পরিচিতি কেসিআর নামে)-এবং তাঁর দল বিআরএস-এর। পরপর দু’বার রাজ্যে ক্ষমতা দখলের পরে হ্যাটট্রিকের লক্ষ্যে নেমেছিল দল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী কেসিআর নিজে হেরেছেন। আর গোটা তেলঙ্গানায় তাঁর দলকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে। তাই ঘনিষ্ঠ মহলে দলীয় নেতারা বলছেন, এই লড়াই ক্ষমতা দখলের নয়, দলের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই।
মেয়ে কবিতা দিল্লির আবগারি দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অপরাধে জেলে বন্দি। হাল এমন যে গত কুড়ি বছরে এই প্রথম কেসিআর পরিবারের কাউকে লোকসভা নির্বাচনে টিকিট দিতে পারেননি। ভাইপো সন্তোষ রাওয়ের রাজ্যসভার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে এ বছরেই। ফলে আগামী দিনে সংসদে কেসিআরের পরিবারের কোনও প্রতিনিধি থাকছেন না। পরিবারভিত্তিক দল হিসাবে পরিচিত কেসিআরের কাছে যা বড় ধাক্কা।
হায়দরাবাদের চন্দ্রায়নগুট্টা এলাকায় বিআরএস-এর প্রাসাদোপম দফতর। তিন তলা ভবনে হাতে গোনা লোক। ভিন্ রাজ্যের সাংবাদিকের মনে তা নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে বুঝে দলের বর্ষীয়ান কর্মী নাগেশ্বর প্রসাদ বললেন, ‘‘যা গরম! সন্ধ্যায় আসুন না! দেখবেন কেমন গমগম করছে।’’ দাবি করছেন বটে, কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয়ের পরে এখন দল ধরে রাখতে গিয়েও হিমশিম কেসিআর। শেষ বেলায় জেলায় জেলায় বাসযাত্রা করে মানুষের কাছে পৌঁছনোর কৌশল নিয়েছেন কেসিআর। কিন্তু প্রত্যাখ্যানের যে হাওয়া ছয় মাস আগে ছিল, তা এখনও রয়েছে বলে স্বীকার করে নিচ্ছেন নাগেশ্বর। তাঁর স্বগতোক্তি, ‘‘মানুষ কাছে ঘেঁষছে না। মুখ ফিরিয়ে রেখেছে।’’
এ দিকে ক্ষমতায় এসেই কংগ্রেস কেসিআরের দল ভাঙতে নেমে পড়েছে। গত ছ’মাস দলের নেতাদের যে ভাবে কংগ্রেস তুলে নিয়েছে, তাতে দ্বিতীয় সারির প্রায় কোনও নেতাই অবশিষ্ট নেই। পরিসংখ্যান বলছে, পাঁচ বছর আগে যে ৯ জন সাংসদ তেলঙ্গনায় বিআরএএস-এর টিকিটে জিতেছিলেন, তাঁদের মধ্যেই পাঁচ জনই কেসিআরকে ছেড়ে কংগ্রেস-বিজেপির টিকিটে লোকসভার যুদ্ধে নেমেছেন। ছয় মাস আগে জিতে আসা একাধিক বিধায়কের মধ্যে অন্তত আধ ডজন ইতিমধ্যেই কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। বাকিদের একটি অংশ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল দেখে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায়। নাগেশ্বর রাওয়ের দাবি, সবই মুখ্যমন্ত্রী রেবন্ত রেড্ডির কারসাজি। দিল্লিতে মোদী সরকার যেমন সিবিআই-ইডির ভয় দেখিয়ে বিরোধীদের বশে রাখে বলে অভিযোগ, এখানেও একই অভিযোগ।
শাসক দলের দিকে অভিযোগের আঙুল তুললে কী হবে, তেলঙ্গনার আমজনতা প্রবল ক্ষুব্ধ কেসিআরের উপরে। অধিকাংশের বক্তব্য, দশ বছর ক্ষমতায় থেকে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করেননি কেসিআর। সেকেন্দ্রবাদের প্যারাডাইস সার্কল এলাকায় সপ্তাহান্তের সন্ধ্যায় খেতে এসেছিলেন কর্মসূত্রে হায়দরাবাদের বাসিন্দা জয় চৌধুরী। বললেন, ‘‘চুরি-ডাকাতি এখানে অনেক কম। কেসিআর-এর সময়ে তা আরও কমে এসেছিল। কিন্তু সরকারের সব বিভাগে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি। গত মন্ত্রিসভার অধিকাংশ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কিছু না কিছু অভিযোগ। নতুন রাজ্যকে এ ভাবে লুটেপুটে খাওয়া ভাল ভাবে দেখেননি কেউ।’’
পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প যেমন কৃষকদের ঋণ মাফ, চাষের জন্য জল কোনও কিছুই বাস্তবে রূপায়িত করতে পারেননি দশ বছরের সরকার। এ নিয়ে কৃষক সমাজের যে প্রবল ক্ষোভ রয়েছে তা রাজ্যের গ্রামীণ এলাকায় ঘুরলেই আঁচ পাওয়া যায়। হায়দরাবাদ লাগোয়া কেন্দ্র মালকাজগিরি এলাকা কৃষিবহুল। স্থানীয় কৃষক রমেশ কুমার বলেন, ‘‘গত দশ বছরে মালকাজগিরি ও আশেপাশের এলাকায় একশোর বেশি কৃষক ঋণের ফাঁদে আটকা পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। তাদের পরিবার সরকারি সাহায্য পর্যন্ত পাননি।’’
প্রতিকূল পরিস্থিতি বুঝে কেসিআরও পাল্টে চালে কার্যত সব কেন্দ্রেই নতুন মুখকে টিকিট দিয়েছেন। নতুন বিআরএস গড়ার ডাক দিয়েছেন তিনি। কেসিআরের ভাগ্নে তথা প্রাক্তন সেচমন্ত্রী হরিশ রাওয়ের যুক্তি, ‘‘বিধানসভা নির্বাচনে পুরনো বিধায়কদের দল প্রার্থী করেছিল। তাঁদের বিরুদ্ধে যে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া রয়েছে তা বোঝা যায়নি। সেই কারণে লোকসভায় অধিকাংশই নতুন প্রার্থী দিয়েছে দল।’’ এ ছাড়া, কেসিআর ফের তেলেঙ্গনা অস্মিতাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। প্রচারে নেমে বলছেন, নতুন রাজ্য হওয়ার পরে হওয়ার পরে দশ বছর অতিক্রান্ত। এ বার রাজধানী হায়দরাবাদকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করবে দিল্লির বিজেপি সরকার। কেসিআরের অভিযোগ, এ পূর্ণ সমর্থন রয়েছে কংগ্রেসের।
আক্রমণের প্রশ্নে বিজেপি ও কংগ্রেস দুই জাতীয় দলকে এক পংক্তিতে রেখে অন্তত চার থেকে পাঁচটি আসন জেতার চেষ্টা করছেন কেসিআর। তাঁর প্রথম লক্ষ্য, কংগ্রেসের সমান বা শাসক দলের চেয়ে অন্তত একটি আসন বেশি পাওয়াযা। যাতে আটকানো যেতে পারে দলত্যাগ। সেই কারণে কংগ্রেস সরকার গত একশো দিনে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ কিংবা চাষীদের ঋণ মকুবে ব্যর্থ হয়েছেন— সেই প্রচারে জোর দিচ্ছেন কেসিআর। পাশাপাশি রাজ্যের কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী রেবন্ত রেড্ডি ও নরেন্দ্র মোদীর ‘আঁতাঁত’ নিয়েও সরব হয়েছেন
তিনি। দ্বিতীয়ত, বিজেপির সঙ্গে ভবিষ্যতে জোটের রাস্তা খোলা রাখার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছেন কেসিআর। সেই কারণে কংগ্রেসকে প্রকাশ্যে আক্রমণ শানালেও, বিজেপির প্রতি তুলনামূলক নরম মনোভাব দেখিয়ে চলার অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। যদি বিজেপি একক শক্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়, তা হলে আগামী দিনে কেন্দ্রীয় সরকারের শরিক হয়ে নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার পথ খোলা রাখতে চাইছেন তিনি।
দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার এমন পরিস্থিতি আগেও এসেছে কেসিআরের। তবে তত বারই প্রত্যাবর্তন করেছেন পোড়খাওয়া রাজনীতিক। এ বারও কি তাই হবে? না কি আরও অতলে তলিয়ে যাবে তাঁর দল?