Lok Sabha Election 2024

পুরভোট, ‘অদেখা’ সাংসদ, লক্ষ্মীর ভান্ডারে ঘুরছে কেন্দ্র

বৈশাখের ঝাঁঝালো রোদে চোখেমুখে একরাশ উদ্বেগ নিয়ে প্রসূনকে হাত তুলে কিছু যেন বলতে চাইছিলেন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মকসুরা বেগম, রুকসনা বেগমরা।

Advertisement

দেবাশিস দাশ

হাওড়া শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০২৪ ০৮:৩৯
Share:

প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

জায়গার নাম পোলগুস্তিয়া ইসলামপুর। হাওড়ার পাঁচলা বিধানসভা কেন্দ্রের সংখ্যালঘু প্রধান প্রত্যন্ত গ্রাম। কিছুক্ষণ আগেই হাওড়া সদর লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় হুডখোলা জিপে, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জনতার দিকে হাত নাড়ছিলেন। তার পর ধুলোর ঝড় তুলে রানিহাটির দিকে চলে গেল প্রচার।

Advertisement

বৈশাখের ঝাঁঝালো রোদে চোখেমুখে একরাশ উদ্বেগ নিয়ে প্রসূনকে হাত তুলে কিছু যেন বলতে চাইছিলেন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মকসুরা বেগম, রুকসনা বেগমরা। পরনে আটপৌরে অপরিচ্ছন্ন শাড়ি। আলগোছে দেওয়া মাথায় ঘোমটা। কিন্তু ভোট প্রচারে ব্যস্ত প্রসূনের তখন কথা শোনার সময় কোথায়?

কী বলতে চাইছিলেন তাঁরা প্রাক্তন ফুটবলার অর্জুনকে?

Advertisement

মকসুরা বেগম, রুকসানা বেগমরা বলেন, ‘‘আমরা ওঁকে কোনও দিন দেখিনি। তাই শুধু ওঁর কাছে জানতে চাইছিলাম, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার টাকা কবে পাব?’’ তাঁদের কথায়, ‘‘আমরা খুব গরিব। পুরনো মাটির বাড়ি ভেঙে পড়ছে। ত্রিপল টাঙিয়ে আছি কোনও মতে। লক্ষ্মীর ভান্ডার পাইনি। বারবার পঞ্চায়েতে গিয়েও আবাসের টাকা মেলেনি।’’

জায়গার নাম হীরাপুর। সাঁকরাইল বিধানসভা এলাকার আর একটি সংখ্যালঘু প্রধান এলাকা। আগের রাতে তুমুল ঝড়বৃষ্টি। পর দিন মনোরম সকাল। গত দু’মাস ধরে সদর লোকসভার ৭টি বিধানসভা এলাকায় এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত মূলত পায়ে হেঁটেই প্রচার করছেন সিপিএমের তরুণ প্রার্থী সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়। সেই সাতসকালেও হাজির হীরাপুরে। তাঁকে দেখেই ভিড় জমেছে সরু গলিতে। রাস্তার পাশের দোতলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন প্রৌঢ় গৃহকর্তা। ভোটপ্রার্থীর হাত ধরে মিনতি করেছেন, ‘‘আমরা সাঁকরাইলের লোকজন অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত। পানীয় জল পাই না, রাস্তা নেই, ভোটে জেতার পর আর কেউ আসে না। আপনি জিতলে ফের আসবেন তো?’’

পাঁচলার ইসলামপুর বা সাঁকরাইলের হীরাপুরের এ সব কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শুধু ক্ষেত্র বিশেষে পাল্টে গিয়েছে গ্রাম থেকে শহরাঞ্চলে। শহরাঞ্চলের মানুষ ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন গত ৬ বছর ধরে হাওড়া ও বালি পুরসভায় নির্বাচন না হওয়ার জন্য। মুখ খুলেছেন শহরের দুরবস্থা, একের পর এক বন্ধ হয়ে যাওয়া কলকারখানা নিয়ে। অথবা শহর জুড়ে বেআইনি টোটোর দাপট বা হাওড়া পুরসভা এলাকা জুড়ে বেআইনি নির্মাণ ও পুকুর ভরাটের মতো বিষয়গুলি নিয়ে।

এই অভিযোগগুলিকেই অস্ত্র করে মাঠে নেমে পড়েছেন বিরোধীরা। অন্য দিকে, বিজেপির বিরুদ্ধে ১০০ দিনের টাকা না-দেওয়া, রাজ্যের কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো জনমুখী প্রকল্প নিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছে তৃণমূল। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা তাই মনে করছেন, এ বারে গঙ্গার পশ্চিম পারে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। লড়াই হবে ত্রিমুখী।

কেউই তাই এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে নারাজ। তীব্র গরমেও দিবারাত্র প্রচার করেছেন হাওড়ার তৃণমূলের প্রাক্তন মেয়র, এ বারে বিজেপি প্রার্থী চিকিৎসক রথীন চক্রবর্তীও। রথীন বলছেন, ‘‘অন্য রাজনৈতিক দলে থাকলেও আমি মেয়র হিসেবে হাওড়াকে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু গত ৬ বছর ধরে পুরনির্বাচন না করে হাওড়ার যে হাল হয়েছে, তা মানুষ দেখছেন। আমি ধর্মনিরপেক্ষ ভাবে উন্নয়ন করেছিলাম।’’

গত ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বিজেপি প্রার্থী ছিলেন বহিরাগত, এ বার ভূমিপুত্র। তা হলে কি এবার ‘অ্যাডভান্টেজ’? রথীন বলেন, ‘‘আমাদের হাওড়ায় দেড়শো বছরের বাস। চিকিৎসক হিসেবে প্রচুর মানুষ আমায় ভালবাসেন। বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, শুধু হিন্দু ভোট নয়, এ বারে সংখ্যালঘু ভোট অনেকটাই বিজেপির দিকে যাবে।’’

সারেঙ্গায় ভোট প্রচারের সময় দেখা সিপিএম প্রার্থী সব্যসাচীর সঙ্গে। ঘামে সাদা পাঞ্জাবি শরীরে লেপ্টে আছে। গলায় সাদা উত্তরীয়। তিনিও হাওড়ার বাসিন্দা। বলছেন, ‘‘দেখুন, এক জন সাংসদের কাজ শুধুমাত্র বাতিস্তম্ভ লাগানো নয়। সাংসদের কাজ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা নেওয়া। সংসদে এত বছর ধরে হাওড়ার জন্য, হাওড়ার পরিবেশের জন্য কেউ কিছু বলেননি। তা হলে মানুষ বিজেপি-তৃণমূলকে ভোট দেবে কেন?’’

তিন বারের সাংসদ এ বারের তৃণমূল প্রার্থী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা ‘ভোটপাখি’র অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়ে জোর কদমে প্রচার করেছেন গত দু’মাস ধরে। তবে তাঁকে ফের প্রার্থী করা নিয়ে দলের মধ্যেই যে একটা বিরোধী চোরা স্রোত বইছে, তা মানছেন দলেরই একাংশ। এ বিষয়ে জেলার এক প্রথম সারির তৃণমূল নেতার বক্তব্য, ‘‘এই যে প্রার্থীকে নিয়ে এত জনসভা, র‌্যালি হচ্ছে, তা অনেকটাই নাটক। আসলে দলের স্বার্থে অনেকেই বাধ্য হয়ে এ সব করছেন। প্রসূনদার আগেই জনসংযোগ বাড়ানো উচিত ছিল।’’

প্রসূন অবশ্য এ সবে গুরুত্ব দিতে নারাজ। সব জায়গায় প্রচারে তিনি বলছেন, ‘‘আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রার্থী। তাই মানুষ দিদিকে দেখে আমায় ভোট দেবে।’’

এ সব দলীয় কোন্দল সত্ত্বেও এ বারের নির্বাচন যে অনুন্নয়ন, সংখ্যালঘু ভোট আর লক্ষ্মীর ভান্ডার নির্ভর, সে ব্যাপারে নিশ্চিত সব দলই। যদিও নির্বাচন অবাধ ও শান্তির্পূণ হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ অনেকেরই। কারণ গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ‘নীরব সন্ত্রাসে’র কথা মানুষের মনে এখনও দগদগে।

ভোটের ১০ দিন আগেই সেই ‘পুরনো ঘায়ে’র একটা ঝলক মিলেছে হাওড়ার প্রত্যন্ত গ্রাম পোলগুস্তিয়ার মল্লিকবাড়ি মোড়ের সামনে। ভুবন শেখ, শেখ জামালুদ্দিনরা চাপা স্বরে বলছিলেন এলাকায়

তৃণমূল নেতারা কোনও উন্নয়ন করেননি, অথচ যাঁরা বিড়িটাও চেয়ে খেতেন তাঁরাই এখন কোটিপতি, এলাকার সর্বেসর্বা। তখনই রাস্তার ও-পারের চায়ের দোকান থেকে (দীর্ঘক্ষণ ধরে প্রতিবেদক ও সঙ্গী চিত্র সাংবাদিককে লক্ষ্য রাখা) হলুদ গেঞ্জি পরা এক যুবক এসে ধমকের সুরে বলেছেন, ‘‘এখানে ‌কী করছিস রে তোরা? এখানে ভিড় করবি না। চলে যা।’’

তার পরে মোটরবাইক হাঁকিয়ে তিনি সাঁ করে ইসলামপুরের কালো পিচ রাস্তায় হারিয়ে গেলেন। রেখে গেলেন প্রশ্ন, ২০ মে হাওড়ার ভোট অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হবে তো?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement