চন্দ্রবাবু নায়ডু। — ফাইল চিত্র।
মিশন ১৭৫!
‘‘বিজেপি যদি ৪০০ আসনের স্বপ্ন দেখে, আমরা কেন ১৭৫ আসন পাব না?’’
আসন্ন লোকসভার সঙ্গেই হতে যাওয়া বিধানসভা নির্বাচনে ১৭৫টি আসনে জেতার ডাক দিয়েছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তথা ওয়াইএসআর কংগ্রেস নেতা জগন্মোহন রেড্ডি। ছয় মাস আগে ভোট হলে সম্ভবত অনায়াসে জিততেন। কিন্তু যত সময় গড়িয়েছে, জগনের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছেন অন্ধ্র তথা জাতীয় রাজনীতিতে পোড় খাওয়া নেতা, তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি)-র চন্দ্রবাবু নায়ডু। সঙ্গে পেয়েছেন বিজেপি ও অভিনেতা পবন কল্যাণের জনসেনা দলকে। এই ত্রি-শক্তির মোকাবিলায় রীতিমতো কালঘাম ছুটছে জগনের। আজ প্রচারের শেষ দিনে নায়ডুর ঘোষণা, মানুষের ক্ষোভ দেখে তিনি বুঝেছেন জগন সরকারের বিদায় নিশ্চিত। তাঁর দাবি, বিধানসভা তো জিতছেনই, লোকসভার ২৫টির মধ্যে অন্তত ২০টি আসন জিততে চলেছে জোট দলগুলি।
পাঁচ বছর আগে জগনের কাছে গো-হারা হেরে রাজ্য রাজনীতিতে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছিলেন চন্দ্রবাবু। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে স্কিল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের তহবিল কেলেঙ্কারি মামলায় জেলেও যেতে হয়েছিল তাঁকে। ৫৩ দিনের ওই জেল সফরে কার্যত তাঁর প্রতি আমজনতার সহানুভূতির ঝড় ওঠে। জগন সরকার প্রতিশোধের লক্ষ্যেই নায়ডুকে জেলে পাঠিয়েছে বলে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া সমর্থকেরাও ফের দলের পাশে দাঁড়াতে শুরু করেন।
সেই শুরু। রাজ্যে গত ছয় মাসে এমন গতিতে নিজের হারানো জমি পুনরুদ্ধার শুরু করেন নায়ডু যে, জগনের গদি টলোমলো। ওয়াইএসআর কংগ্রেসের একাধিক নেতা যোগ দিয়েছেন নায়ডু শিবিরে। জগনকে হারাতে জগনের দেওয়া প্রতিশ্রুতিকেই হাতিয়ার করেছেন নায়ডু। প্রশ্ন তুলেছেন, কোথায় গেল রাজ্যের জন্য বিশেষ মর্যাদার প্রতিশ্রুতি? তিনটি রাজধানী গড়ে তোলার আশ্বাস কোথায় গেল?
গুন্টুর বাসস্ট্যান্ডে বিজয়ওয়াড়া যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন সরকারি শিক্ষক প্রকাশ কুমার। বললেন, ‘‘পাঁচ বছরে কোনও উন্নতি হয়নি রাজ্যের। কেবল খয়রাতির রাজনীতি হয়েছে। যার ফলে রাজ্যের মাথায় পাহাড়প্রমাণ ঋণ। শুনেছি বিজেপিকে সংসদে পরোক্ষে সাহায্য করায় বিজেপি আর্থিক নীতির তোয়াক্কা না করে জগনকে অর্থসাহায্য করে গিয়েছে। সেই টাকা নগদে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে ভোটারদের। নায়ডু সরকারের আমলে অন্তত রাজ্যে বিনিয়োগ আসত। কিন্তু এই আমলে শিল্প সংস্থাগুলোর বড় অংশ পাততাড়ি গুটিয়ে অন্য রাজ্যে চলে গিয়েছে।’’ প্রকাশের সঙ্গেই ছিলেন ছাত্র সত্যকুমার। তাঁর কথায়, ‘‘উচ্চশিক্ষার খরচ ভীষণ বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু পাশ করেও চাকরি নেই। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে পড়ুয়ারা চাকরি না পেয়ে খাবার ডেলিভেরি সংস্থায় কাজ করছেন।’’
অতীতে এনডিএ জোট ভেঙে বেরিয়ে এলেও, এ যাত্রায় ফের বিজেপির হাত ধরেছেন নায়ডু। পাশাপাশি মুসলমান ভোটেও সিঁধ কাটতে চেয়ে সংখ্যালঘুদের জন্য একাধিক প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। তার মধ্যে হজযাত্রীদের এক লক্ষ টাকা করে সাহায্য, ইমাম ও মুয়াজ্জিমদের মাসিক এক হাজার ও পাঁচশো টাকা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। মুসলিম প্রবীণদের পঞ্চাশ বছর হলেই অবসরভাতা ছাড়াও জিতে এলে মুসলিমদের ৪ শতাংশ সংরক্ষণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। মুসলিম সংরক্ষণের বিরোধিতা করে বিজেপি গোটা দেশে প্রচারে নামলেও ব্যতিক্রম অন্ধ্রপ্রদেশ। এ রাজ্যে ৯.৫ শতাংশ মুসলিমদের জন্য নায়ডু একের পর এক প্রতিশ্রুতি দিলেও, কার্যত বিষয়টি না দেখার কৌশল নিয়েছেন বিজেপি নেতৃত্ব।
জগনের তাই পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘নায়ডুকে জেতাতে কি নিজেদের সব নীতি বিসর্জন দিল গেরুয়া শিবির? গোটা দেশ জুড়ে প্রধানমন্ত্রী কংগ্রেসের ইস্তাহারে মুসলিম তোষণের সমালোচনা করে সরব হলেও অন্ধ্রপ্রদেশে নায়ডু যে খুল্লমখুল্লা তোষণের রাজনীতি করছেন, সে প্রসঙ্গে নীরব মোদী ও তাঁর দল।’’
অভিযোগের জুতসই জবাব দিতে ব্যর্থ বিজেপি। গুন্টুরের গুন্ডিপাড়া এলাকায় বিজেপি দফতরে বসে থাকা কর্মী নারায়ণ রাওয়ের মতে, ‘‘জগনকে হটিয়ে রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাটাই অগ্রাধিকার। বাকিটা পরে বুঝে নেওয়া যাবে।’’ অন্ধ্রপ্রদেশে ২৫টি লোকসভার মধ্যে ছ’টিতে লড়ছে বিজেপি। আগামী সোমবার ভোট হতে যাওয়া অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলঙ্গনায় দলের আসন বৃদ্ধি পাবে বলেই আশা করছেন বিজেপি নেতৃত্ব। বিশেষ করে নায়ডুর সমর্থনে এ যাত্রায় অন্ধ্রপ্রদেশের জমিতে গেরুয়া ফুল ফুটবে, এই আশায় বুক
বেঁধেছেন কর্মীরা।
জগনের বিরুদ্ধে নায়ডু পাশে পেয়েছেন অভিনেতা তথা জনসেনা দলের নেতা পবন কল্যাণকে। সংখ্যার হিসাবে কেবল দু’টি লোকসভা ও একুশটি বিধানসভা আসন দেওয়া হয়েছে পবনকে। কিন্তু নায়ডুর লক্ষ্য, পবনকে সামনে রেখে কাপু সমাজের ভোট নিশ্চিত করা। অন্ধ্রে তাদের প্রায় ২৪ শতাংশ ভোট রয়েছে। গুন্টুরের জনসেনা দলের নেতা চন্দ্রশেখরের মতে, উপকূলবর্তী অন্ধ্রে কাপু সমাজের আধিক্য রয়েছে। পাঁচ বছর আগে
ওই এলাকায় ৯৮টি আসন জিতেছিলেন জগন। এ বারে সেই এলাকাতেই আঘাত করার পরিকল্পনা নিয়েছেন চন্দ্রবাবু।
পবনের সমর্থনে ময়দানে নেমেছেন তাঁর দাদা চিরঞ্জীবী। যাতে প্রবল ভাবে সাড়া দিয়েছে কাপু সমাজ। অন্ধ্রপ্রদেশের প্রেক্ষাগৃহে গত শুক্রবার পুনরায় মুক্তি পেয়েছে পবনের ছবি ‘উকিলসাব’। হিন্দি ছবি ‘পিঙ্ক’-এর ছায়ায় তৈরি এই ছবিতে ‘নো মিনস নো’ সংলাপকে প্রচারে হাতিয়ার করেছেন পবন। প্রতিটি জনসভায় জগনকে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে ‘নো মিনস নো’ বলে ডাক দিচ্ছেন। আগের ভোটগুলিতে সে ভাবে দাগ না কাটলেও তিনি যে লম্বা রেসের ঘোড়া, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই নায়ডু বা বিজেপির।