টিটাগড়ের দেশবন্ধু কলোনিতে ব্যারাকপুরের বিজেপি প্রার্থী অর্জুন সিংহকে ঘিরে তৃণমূলের বিক্ষোভ। সোমবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
কপালে দইয়ের ফোঁটা। হাতে সাদা স্ট্র্যাপ, সাদা ডায়ালের র্যাডো ঘড়ি। সাদা শার্ট আর ট্রাউজ়ার্সের নীচে পা-ঢাকা জুতোও সাদা। অন্য রং বলতে গলায় ঝোলানো নীল ফিতে লাগানো ভোটপ্রার্থীর ব্যাজ আর দু’হাতের মধ্যমা এবং কনিষ্ঠা মিলিয়ে নানা রঙের পাথর বসানো মোট চারটি আংটি। এই অল্পবিস্তর বেরং বাদ দিলে সাদা পোশাকের ধোপদুরস্ত অর্জুন সিংহের কপালেই যেন চিন্তার ভাঁজ। তাঁর ব্যারাকপুর কেন্দ্রে সোমবার ভোটের দিন সেই চিন্তিত মুখে কার্যত ‘ঘোড়ায় জিন দেওয়া’র মতো করে তিনি ছুটে বেড়ালেন এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। কখনও ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ তুললেন, কখনও হাতাহাতিতে জড়ালেন। তাঁকে ঘিরে ‘গো ব্যাক’ স্লোগানও উঠল বেশ কিছু জায়গায়। দিনের শেষে বুথে ঢুকে প্রিসাইডিং অফিসারকে মারতে যাওয়ার অভিযোগও উঠল অর্জুনের বিরুদ্ধেই। মেজাজ হারিয়ে সেখানে তাঁকে বলতে শোনা গেল, ‘‘আমি আপনার চাকরি খেয়ে নেব।’’
তবে কি এ বার পরিস্থিতি কঠিন মনে হচ্ছে? শিল্পাঞ্চলের ‘বাহুবলী’ নেতা দাপটের সঙ্গে বললেন, ‘‘২৮ দিনে রুলিং পার্টিকে হারিয়েছিলাম!’’ কিন্তু ২০২২ সালে সেই শাসকদলেই তো ফিরলেন? ২০২৪ সালে আবার ব্যারাকপুরের টিকিট না-পেয়ে দুম করে বিজেপিতে যোগ দিলেন। লোকে তো বলছে, আপনার গ্রহণযোগ্যতা কমছে? মুখ-চোখ কঠিন করে এ বার অর্জুনের জবাব, ‘‘পুরনো কথা তুলে লাভ নেই। অর্জুন সিংহকে ব্যারাকপুরে হারায়, এখনও এমন কারও জন্ম হয়নি।’’
অর্জুনের এ দিনের কর্মসূচি শুরু হয়েছিল সকাল সাড়ে সাতটায়। ভাটপাড়ায় তাঁর বসতবাড়ি ‘মজদুর ভবন’ থেকে বেরিয়ে তিনি প্রথমে যান পাড়ার বুথে ভোট দিতে। সেখান থেকে বেরিয়ে সেই যে নিজের সাদা এসইউভি-তে সওয়ার হয়েছেন, আর নামার নাম করেননি প্রায় ঘণ্টা তিনেক। মূলত নৈহাটি, হালিশহর, কাঁচরাপাড়া হয়ে ছুটে বেড়িয়েছে অর্জুনের গাড়ি। তিনি এক বার গাড়ি থেকে নামেন বীজপুরের নবীনপল্লি এলাকায় একটি বুথের কাছে। তাঁর অভিযোগ, সেখানে বিজেপির এক মহিলাকে মারধর করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে অর্জুনকে ঘিরে ধরে শুরু হয় ‘গো ব্যাক’ স্লোগান। তাঁকে লক্ষ্য করে এক যুবককে বলতে শোনা যায়, ‘‘আমি বনি, নামটা মনে আছে তো? তুমি আমার কিছুই করতে পারবে না।’’ পাল্টা অর্জুনকেও বলতে শোনা যায়, ‘‘ভোট মিটুক, তার পরে দেখে নেব!’’
এর পরে অর্জুন বিক্ষোভের মুখে পড়েন টিটাগড় চার নম্বর জলের ট্যাঙ্কের কাছে দেশবন্ধু কলোনিতে। সেখানে তিনি পৌঁছতেই তাঁকে কালো পতাকা দেখানো হয়। রীতিমতো হাতাহাতি শুরু হয়ে যায় অর্জুনের সঙ্গে। বিজেপি প্রার্থীকে ঘুষি চালাতেও দেখা যায় সেখানে। ভাঙচুর করা হয় চেয়ার। পরিস্থিতি সামাল দিতে লাঠি চালায় পুলিশ। কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা কোনও মতে বার করে আনেন অর্জুনকে। এর পরে তিনি পৌঁছন বিজেপি নেতা কৌস্তুভ বাগচীর কাছে। তত ক্ষণে ব্যারাকপুরের মণ্ডলপাড়ায় কৌস্তুভের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। অর্জুনকে বলতে শোনা যায়, ‘‘সব আক্রমণের হিসাব এর পরে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেব।’’
মণ্ডলপাড়ার পরে বিজেপি প্রার্থী যান জগদ্দল থানার কাউগাছিতে। সেখানে একটি বুথের ভিতরে তেড়ে যেতে দেখা যায় তাঁকে। অর্জুনের অভিযোগ, সেখানে ছাপ্পা ভোট করাচ্ছিলেন এক তৃণমূল নেতা। প্রিসাইডিং অফিসারকে গিয়ে অর্জুন বলেন, ‘‘নিজের কাজ করতে জানেন না?’’ ঘুষি পাকিয়ে তেড়ে গিয়ে এর পরে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘‘আপনার চাকরি খেয়ে রেখে দেব আমি। আপনি জানেন না, আমি কী জিনিস!’’
ঘুরতে ঘুরতেই দুপুরের পরে হালিশহর পাঁচমাথা মোড়ের কাছে একটি চায়ের দোকানে মিনিট কয়েক বসেন চটকল মজদুরদের নেতা অর্জুন। কথা উঠল, তাঁর পরিবার অর্থাৎ সিংহদের বাংলা রাজনীতিতে এক বিরল দৃষ্টান্ত প্রসঙ্গে। ভাটপাড়া কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের হয়ে বিধায়ক হয়েছিলেন অর্জুনের বাবা সত্যনারায়ণ সিংহ। এর পরে অর্জুন। পরে ওই কেন্দ্রেই জেতেন অর্জুন-পুত্র পবন। স্ত্রী, ছেলেকে নিয়ে বিতর্ক কতটা অপ্রস্তুতে ফেলে এখন?
হেসে অর্জুন বললেন, ‘‘রাজনীতিতে নামলে সব মেনে নিতে হয়।’’ কিন্তু বাবার এই ভোটে ছেলে কোথায়? অর্জুনের ছোট্ট উত্তর, ‘‘বাড়িতেই আছে।’’ বাবা দল বদলে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যাওয়ার পরে নাকি বাবা-ছেলের মধ্যে কথা বলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অর্জুন ঘনিষ্ঠেরা বলেন, কথা বন্ধ করেছিলেন পবনই। এখন আবার অর্জুন বিজেপিতে ফেরায় পবনের সঙ্গে ছবি দেওয়া পোস্টার পড়েছে তাঁর। তাতে লেখা, ‘তোর টিমে, তোর পাশে’।
কিন্তু এই খেলায় জয় হবে তো? অর্জুনের উত্তর, ‘‘এক লক্ষেরও বেশি ভোটে জিতব।’’