রবিবার দিল্লির রামলীলা ময়দানে (বাঁ দিক থেকে) মল্লিকার্জুন খড়্গে, শরদ পওয়ার, সনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, ভগবন্ত মান, ফারুক আবদুল্লা, তেজস্বী যাদব-সহ অন্য বিরোধী নেতানেত্রীরা। ছবি: পিটিআই।
‘লোকতন্ত্র বাঁচাও’-এর ডাক দিয়ে দিল্লির রামলীলা ময়দানে সভা করল বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’। লোকসভা ভোটের আগে বিরোধী জোটের ঐক্যের ছবিটিও ধরা পড়ল রবিবারের সভা থেকে। মঞ্চে পাশাপাশি দেখা গেল কংগ্রেসের মল্লিকার্জুন খড়্গে, রাহুল গান্ধী, সনিয়া গান্ধী, প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরা, সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি, আরজেডির তেজস্বী যাদব, এসপির অখিলেশ সিংহ যাদব, তৃণমূলের ডেরেক ও ব্রায়েনকে। তবে আলাদা করে নজর কাড়লেন দুই নারী। সুনীতা কেজরীওয়াল এবং কল্পনা সোরেন। প্রথম জনের স্বামী দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। বর্তমানে দিল্লির আবগারি দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত হয়ে ইডির হেফাজতে রয়েছেন। আর দ্বিতীয় জনের স্বামী ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন। যিনি জমি দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হওয়ার আগে মুখ্যমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন।
কেজরীওয়ালের গ্রেফতারি-সহ একাধিক ইস্যুকে সামনে রেখেই বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ রবিবারের সমাবেশের ডাক দিয়েছিল। সেই সভায় প্রথম বক্তৃতা করতে মঞ্চে ওঠেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী সুনীতা। বলতে গেলে এটাই তাঁর প্রথম কোনও রাজনৈতিক সভা। কেজরীওয়াল গ্রেফতার হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রাক্তন এই আমলাকে তেমন ভাবে কোনও রাজনৈতিক মঞ্চ বা জমায়েতে দেখা যায়নি। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে তিনিই সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে রয়েছেন। ইডি হেফাজত থেকে স্বামীর বিভিন্ন বার্তা সকলের সামনে পাঠ করে শোনাচ্ছেন তিনি। রবিবারও তাঁর অন্যথা হল না। বন্দি স্বামীর পাঠানো বার্তা সকলের সামনে পড়ে শোনান তিনি। দিল্লি তথা দেশবাসীর জন্য আম আদমি পার্টি (আপ)-র দেওয়া ছয় দফা ভোট প্রতিশ্রুতির কথাও জানিয়েছেন তিনি।
সুনীতা যেখানে শেষ করেছেন, ঠিক সেখান থেকেই বক্তৃতা শুরু করেন কল্পনা। ‘লোকতন্ত্র বাঁচাও’ সমাবেশে যোগ দিতে শনিবারই ঝাড়খণ্ড থেকে দিল্লি উড়ে এসেছিলেন কল্পনা। দিল্লি এসে সোজা চলে যান কেজরীওয়ালের বাসভবনে। সেখানে দেখা করেন সুনীতার সঙ্গে।
বক্তৃতা করতে উঠে বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চড়া সুরে আক্রমণ করেন রাহুল। দাবি করেন যে, ঠিকঠাক ভোট হলে বিজেপি ১৮০টির বেশি আসন পাবে না। মোদী তথা বিজেপির ‘৪০০ পার’ স্লোগানের কটাক্ষ করে তাঁর মন্তব্য, ‘‘ম্যাচ ফিক্সিং ছাড়া ৪০০ পার করা অসম্ভব।’’ সভায় বক্তৃতা করেন প্রিয়ঙ্কাও। তিনি রামায়ণের অনুষঙ্গ টেনে বলেন, “রাম সত্যের জন্য লড়েছিলেন। আসলে সত্যই জিতবে। ঔদ্ধত্য হারবে।” তার পরই বিরোধী জোটের তরফ থেকে স্বচ্ছ এবং অবাধ ভোটের জন্য জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঁচ দফা দাবি জানান তিনি।
লোকসভা ভোটে কোনও আসনে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা না হলেও রবিবার ‘ইন্ডিয়া’-মঞ্চে তৃণমূলের দুই দূত হিসাবে হিসাবে উপস্থিত ছিলেন দলের রাজ্যসভার দলনেতা এবং জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন। তিনি জানান, ‘ইন্ডিয়া’র অংশ হিসাবেই থাকবে তৃণমূল।
ঐক্যের ছবি ‘ইন্ডিয়া’য়
লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে বিরোধী জোটের ছন্নছাড়া দশা দেখে বিদ্রুপ করছিল শাসক বিজেপি। গত ১৭ মার্চ মুম্বইয়ে কংগ্রেসের ‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’য় বিরোধী ঐক্যের ছবি তুলে ধরার চেষ্টা হলেও, সেখানে উল্লেখযোগ্য ভাবে গরহাজির ছিল তৃণমূল এবং বাম দলগুলি। সূত্র মারফত জানা গিয়েছিল, বিভিন্ন রাজ্যে আসন সমঝোতা নিয়ে মতপার্থক্যের জেরেই ঐক্যের ছবি দেখা যায়নি মুম্বইয়ে। সেটা অবশ্য কংগ্রেসের নিজস্ব কর্মসূচি ছিল। কেজরীওয়ালের গ্রেফতারির পরেই অবশ্য এক সুরে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে আক্রমণ শানিয়েছিল বিরোধী দলগুলি। সেই সুর ধরা পড়ল রবিবারেও। সূত্রের খবর, রবিবারের সমাবেশে বিজেপি বিরোধী প্রায় ২৭-২৮টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। রাহুল গান্ধী, মল্লিকার্জুন খড়্গে, তেজস্বী যাদব, মেহবুবা মুফতি, উদ্ধব ঠাকরে— সকলেই বিজেপিকে আক্রমণ শানান। নীতীশ কুমারের এনডিএ-তে ফিরে যাওয়া, আরএলডি-র ‘ইন্ডিয়া’-ত্যাগের পর এই জোটের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল। তবে ভোটের আগে বিরোধীদের এই ঐক্যের ছবি বিজেপিকে অস্বস্তিতে রাখবে বলেই মনে করছেন অনেকে।
দুই নারী, হাতে তরবারি
বিরোধী মঞ্চে নজর কাড়লেন কেজরী-পত্নী সুনীতা এবং হেমন্ত-পত্নী কল্পনা। লোকসভা ভোটে কেজরীওয়ালের ছয়টি প্রতিশ্রুতির কথা শোনান সুনীতা। সেই সঙ্গে তিনি উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী আমার স্বামীকে জেলে বন্দি করে রেখেছেন। আপনারা বলুন তো এটা ঠিক? আপনারা বিশ্বাস করেন তো কেজরীওয়াল দেশপ্রেমিক এবং সৎ ব্যক্তি? এই বিজেপির লোকেরা বলছেন কেজরীওয়ালের পদত্যাগ করা উচিত, কিন্তু আপনারাই বলুন, তাঁর কী করা উচিত?” এর পরই সুনীতা গলা চড়িয়ে বলেন, ‘‘আপনাদের কেজরীওয়াল সিংহ। তাঁকে বেশি দিন জেলে বন্দি করে রাখা যাবে না।’’ কল্পনা বলেন, ‘‘আমাদের শক্তি দেশের ১৪০ কোটি মানুষের। এনডিএ সরকার বাবা অম্বেডকরের সংবিধান নষ্ট করে দিতে চাইছে। আমরা তা রুখবই। দেশের মানুষের থেকে বড় কোনও শক্তি হয় না। সেই শক্তি আমাদের সঙ্গে আছে। এই জনসমুদ্রই সেটা প্রমাণ করছে। ভারতের লোকতন্ত্র বাঁচাতেই হবে আমাদের।’’ আক্ষরিক অর্থে দু’জনের হাতে তরবারি না থাকলেও ভোটের ময়দানে রাজনীতিক স্বামীদের অবর্তমানে আগ্রাসী ভঙ্গিতেই তাঁরা এগোনোর ইঙ্গিত দিলেন বলে মনে করা হচ্ছে।
ম্যাচ ফিক্সিং তোপ রাহুলের
মঞ্চে বক্তৃতা করতে উঠে রাহুল বলেন, ‘‘ইভিএম ছাড়া, ম্যাচ ফিক্সিং ছাড়া, সমাজমাধ্যম ছাড়া এবং গণমাধ্যমের উপর চাপ সৃষ্টি ছাড়া বিজেপির পক্ষে ১৮০টির বেশি আসন জেতা অসম্ভব।’’ কী ভাবে ভোটে ‘ম্যাচ ফিক্সিং’ হবে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে রাহুল বলেন, ‘‘এখন আইপিএল চলছে। যখন আম্পায়ারদের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়, খেলোয়াড়দের কিনে নেওয়া হয় এবং অধিনায়ককে হুমকি দেওয়া হয় ম্যাচ জেতার জন্য, সেটা ক্রিকেটে ফিক্সিং। সামনেই আমাদের লোকসভা ভোট আছে। সেখানে আম্পায়ারদের নিজেই বেছেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। আমাদের দুই খেলোয়াড়কে খেলার আগেই গ্রেফতার করে নেওয়া হয়েছে।’’ এখানেই শেষ নয়। রাহুলের দাবি, বেছে বেছে কংগ্রেস নেতাদের হেনস্থার চেষ্টা করছে বিজেপি। তার উপর ভোটের আগে কংগ্রেসের সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রাহুল বলেন, ‘‘আমাদের ভোটের প্রচার করতে হবে। রাজ্যে রাজ্যে কর্মীদের পাঠাতে হবে। পোস্টার তৈরি করতে হবে। কিন্তু আমাদের সব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এটা কী রকমের নির্বাচন?’’ রাহুলের দাবি, আর পাঁচটা ভোটের মতো এ বারের লোকসভা ভোট ‘সাধারণ’ নয়। মানুষ যদি বিজেপিকে না-আটকায় তবে সংবিধান ধূলিস্যাৎ হয়ে যাবে।
পাঁচ দাবি ‘ইন্ডিয়া’র
দেশের সব ক’টি রাজনৈতিক দল যাতে নির্বাচনে সমান সুযোগসুবিধা পায়, সেই জন্য বিরোধী জোটের তরফে কমিশনের কাছে পাঁচ দফা দাবি জানান প্রিয়ঙ্কা গান্ধী। কমিশনের কাছে প্রিয়ঙ্কার প্রথম আর্জি, লোকসভা ভোট শাসক কিংবা বিরোধী, সব দলের জন্য সমান সুযোগসুবিধা থাকার বিষয়টি সুনিশ্চিত করুক নির্বাচন কমিশন। এর পাশাপাশি নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের উদ্দেশে আয়কর দফতর, ইডি এবং সিবিআই যাতে বিরোধীদের প্রতি দমনমূলক পদক্ষেপ করতে না পারে, সে দিকে কমিশনকে নজর রাখার আর্জি জানিয়েছেন তিনি। বিরোধী জোটের তরফে ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা জেএমএম নেতা হেমন্ত সোরেন এবং দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী তথা আপ নেতা অরবিন্দ কেজরীওয়ালকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। বিরোধী দলগুলিকে অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু করার চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে এগুলি বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে কমিশনের কাছে। বিরোধীদের পাঁচ দাবির মধ্যে এসেছে নির্বাচনী বন্ডের প্রসঙ্গও। বিজেপির বিরুদ্ধে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে পাওয়া চাঁদার বিনিময়ে জুলুমবাজির অভিযোগ তুলে এই বিষয়ে তদন্তের জন্য সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠনের আর্জি জানানো হয়েছে। বিজেপি ‘প্রতিহিংসার বশে’ কী ভাবে বিরোধী দল এবং বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে টাকা তছরুপের অভিযোগ আনছে, তা-ও ওই তদন্ত কমিটির আওতায় আনার দাবি জানানো হয়েছে।
পুলওয়ামা-প্রশ্ন তৃণমূলের
সভায় বক্তব্য রাখতে উঠে ডেরেক পুলওয়ামা হামলা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এর পাশাপাশি দাবি করেন যে, এটা বিজেপির সঙ্গে ভারতীয় গণতন্ত্রের লড়াই। পুলওয়ামা প্রসঙ্গে ডেরেক বলেন, “আমরা চাই সত্যিটা সামনে আসুক। আমরা এই নিয়ে শ্বেতপত্র চাই।” মঞ্চের দু’টি ফাঁকা চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “আমরা দুটো আসন ফাঁকা রেখেছি। মাননীয় কেজরীওয়াল এবং মাননীয় সোরেন আপনারা আমাদের সঙ্গেই রয়েছেন।” বিজেপির উদ্দেশে আক্রমণ শানিয়ে তিনি বলেন, “কর্মসংস্থান, মুদ্রাস্ফীতি, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি রক্ষা করার নিরিখে মোদীর গ্যারান্টি আসলে জ়িরো ওয়ারেন্টি।”
থাকল মমতার ছোঁয়া
তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লি না গিয়েও রবিবার উপস্থিত থাকলেন রামলীলা ময়দানে। মঞ্চে রাখা দু’টি এলইডি স্ক্রিনে বার বার ফুটে উঠছিল বিরোধী নেতা-নেত্রীদের মুখ। সেখানে ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিও।
কী বললেন বাকিরা?
প্রধানমন্ত্রী আক্রমণ শানিয়ে আরজেডির তেজস্বী বলেন, “দেশের সবচেয়ে বড় শত্রু বেকারত্ব এবং মুদ্রাস্ফীতি। মোদীজি প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন, কিন্তু কৃষকদের সঙ্গে দেখা করবেন না। বিল গেটসের সঙ্গে দেখা করবেন, কৃষকদের সঙ্গে দেখা করবেন না।” কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে বলেন, “বিজেপি আর আরএসএস বিষের মতো। স্বাদ নিতে যাবেন না। তারা দেশকে ধ্বংস করছে। কিন্তু তাদের আর এই ধ্বংসলীলা চালাতে দেওয়া যাবে না।” শিবসেনা (ইউবিটি)-র উদ্ধব ঠাকরে বলেন, “এক ব্যক্তি এবং এক দলের সরকার দেশের জন্য ভয়ঙ্কর। আমাদের উচিত দেশে জোট সরকার নিয়ে আসা।’’