উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়ায় প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সুজিত দুয়ারি।
সন্দেশখালিতে নারী-নিগ্রহ নিয়ে তীব্র জনমতের মুখেও প্রথমে নীরব ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পরে বলেছিলেন, অনেক অভিযোগই ঠিক নয়। ‘ভুয়ো সন্দেশ’ (সংবাদ) দেওয়া হয়েছে। এ বার সন্দেশখালির নাম উল্লেখ না করেই তাঁর মুখে শোনা গেল, ‘‘ভুল হলে ক্ষমা করে দেবেন।’’
জাত-ধর্মের বিভাজন এবং মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রসঙ্গ টেনে শিলিগুড়িতে মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেছেন, ‘‘আমি চাই না আপনাদের ইজ্জত নিয়ে কেউ খেলা করে। মা-বোনেদের ইজ্জত নিয়ে খেলে। ভুল হলে ক্ষমা করে দেবেন!’’ তবে সন্দেশখালির নাম উল্লেখ না করলেও এই সূত্রে বিজেপিকে বিঁধতে মণিপুরের কথা টেনে এনেছেন তিনি।
প্রায় দু’আড়াই মাস ধরে উত্তপ্ত সন্দেশখালিতে ওঠা গুরুতর অভিযোগগুলি সম্পর্কে প্রথম দিকে কার্যত নীরবই ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বরং, বিধানসভার ভিতরে দাঁড়িয়ে মূল অভিযুক্ত শেখ শাহজাহানকে ‘টার্গেট’ করা হয়েছে বলে দাবি করে বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগই তুলেছিলেন তিনি। আবার নারী দিবস উপলক্ষে কলকাতায় মিছিলের পরে বলেছিলেন, কিছু ঘটে থাকতে পারে। তবে অনেক ‘ভুয়ো সন্দেশ’ও দেওয়া হয়েছে। যদিও শিলিগুড়িতে এ দিন তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমার বিরুদ্ধে কিছু বলার থাকলে সরাসরি বলুন, দিদি, আপনার এটা পছন্দ নয়। আমি শুনব। কেন না, আমি ভগবান নই যে, আমার কখনও ভুল হবে না! যে কাজ করে, তার ভুল হতে পারে।’’ তার পরেই তিনি মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রসঙ্গ টেনে ওই মন্তব্য করেছেন।
গত দু’টি বিধানসভা নির্বাচনেই তফসিলি জাতি সংরক্ষিত আসন সন্দেশখালি তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে এসেছিল। তবে সাম্প্রতিক অশান্তি ও অভিযোগের পরে বিরোধীদের তৎপরতার মুখে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে শাসক দল। এই অবস্থায় সন্দেশখালির নাম না করেও মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
অন্য দিকে, তফসিলি জাতি ও জনজাতি মানুষের মন পেতে রাজ্যব্যাপী বড় কর্মসূচিও নিয়েছে তৃণমূল। প্রায় সাড়ে তিন হাজার কর্মী নামছেন দলের তরফে। কিছুটা অরাজনৈতিক চেহারা দিয়েই আগামী ১৫ মার্চ থেকে এই বিজেপি-বিরোধী প্রচার কর্মসূচি সাজিয়েছে তারা। দেশ জুড়ে সিএএ কার্যকর হওয়ার পরেই এ দিন নজরুল মঞ্চে এই ‘বাহিনী’র নির্দিষ্ট কাজ বুঝিয়ে দিয়েছেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের ‘দিদিকে বলো’, ‘বাংলা নিজের মেয়েকে চায়’ বা ‘তৃণমূলে নবজোয়ার’ কর্মসূচির মতে লোকসভা ভোটের আগে তফসিলি জাতি ও জনজাতি ভোটের কথা মাথায় রেখে এই প্রচার অভিযানে নামছে তৃণমূল। ‘তফসিলি সংলাপ’ নামে এই কর্মসূচির জন্য ১৫০টি গাড়ি ঘুরবে রাজ্যের ৬ হাজার এলাকায়। গৃহীত সূচী অনুযায়ী অন্তত দেড় কোটি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে বাছাই করা দলগুলি কাজ করবে। একেবারে ভোটের প্রচার হলেও কিছুটা ভিন্ন চেহারা দিতে আলাদা সাজ-সজ্জার কথা ভাবা হয়েছে। এই দলগুলি বিভিন্ন এলাকায় অন্তত পাঁচটি রাত কাটিয়ে স্থানীয় সমস্যা সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করে দলকে জানাবে।
রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তফসিলি জাতি ও জনজাতি এলাকার ভোটে তৃণমূলের প্রভাব ক্রমশ কমেছে। রাজ্যে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে তা প্রথম বড় রকমের চোখে পড়েছে। তার পরেও এই ভোটের পুরনো ভাগ না ফেরায় এ বারের লোকসভা নির্বাচনের আগে যোযাযোগ স্থাপনে এই নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দলের বিধানসভা পিছু ১০ জন করে মোট সাড়ে তিন হাজার তফসিলি জাতি ও জনজাতির এই প্রচার-কর্মীদের সঙ্গে এ দিন নজরুল মঞ্চে বৈঠক করেন অভিষেক। সেখানেই রাজ্য তো বটেই, গোটা দেশে তফসিলি জাতি ও জনজাতি মানুষের সমস্যা ও তাঁদের সম্পর্কে বিজেপির ‘নেতিবাচক মনোভাব’ ব্যাখ্যা করে প্রচারের লক্ষ্য স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে তফসিলিদের বিরুদ্ধে অপরাধের তথ্য দিয়ে তা প্রচারের নির্দেশ দিয়েছেন।
অভিষেকের উদ্যোগকে কটাক্ষ করে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অবশ্য দাবি করেছেন, ‘‘কোনও লাভ হবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গুরুচাঁদ ঠাকুরকে ‘গরুচাঁদ’ বলেছিলেন। তার পরে ক্ষমা চেয়েছেন? রাজবংশীদের নিজের পায়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ক্ষমা চেয়েছেন? এর থেকেই বোঝা যায়, ওঁরা কী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন। সন্দেশখালিতে যত মহিলাদের সঙ্গে অত্যাচার হয়েছে, তাঁরা সকলেই তফশিলি জাতি অথবা জনজাতির।’’