লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থীদের নিয়ে র্যাম্পে হাঁটলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়। রবিবার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে দলীয় সমাবেশে। ছবি: সুমন বল্লভ।
অন্যান্য বারের তুলনায় স্বল্প সময়ের বক্তৃতা। ব্রিগেডে তৃণমূল কংগ্রেসের ‘জনগর্জন’ সমাবেশের মঞ্চ থেকে নরেন্দ্র মোদীর ‘গ্যারান্টি’র মোকাবিলায় তাঁর নিজের সরকারের ‘গ্যারান্টি’কে সামনে রাখলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন, শুধু মুখে বলাই নয়, তাঁরা কাজে করে দেখাচ্ছেন। সুর মেলালেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
তৃণমূলের ‘জনগর্জন’ সমাবেশ ডাকাই হয়েছিল রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের ‘বঞ্চনা’র জবাব দেওয়ার লক্ষ্যে। ব্রিগেডের ওই মঞ্চ থেকেই রবিবার লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের সূচনা করে দিলেন মমতা। চলতি মাসে ইতিমধ্যেই চার বার রাজ্যে এসে প্রধানমন্ত্রী ‘মোদীর গ্যারান্টি’র কথা বলে বাংলার মানুষের মন জয়ের চেষ্টা করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা পাল্টা বললেন, রাজ্যের ‘বঞ্চিত’ মানুষের টাকা তাঁর সরকার দিয়ে দেবে। কিন্তু ওই ‘বঞ্চনা’র জবাব ভোটে দিতে হবে। মমতার কথায়, ‘‘কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না, উল্টে মিথ্যা বলে বেড়াচ্ছে টাকা দিয়েছে। কী মোদীবাবু, টাকা না দিয়েই বলছেন, খেয়ে ফেলেছে! তা হলে দিলে কী বলতেন?’’ এই সূত্রেই তৃণমূল নেত্রীর সংযোজন, ‘‘লড়াই করতে গেলে শক্তি প্রয়োজন। সেই শক্তিটা পেতে গেলে তো আপনাদের আশীর্বাদ দরকার। আপনারা সেই শক্তি না দিলে আমরা লড়ব কী ভাবে? ওঁরা না-ই বা দিল টাকা। মানুষ সঙ্গে থাকলে বাংলার সব কাজ করতে পারবে তৃণমূল।’’ আর তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘দিদি না মোদী? কার গ্যারান্টি চায় বাংলা? মোদী না দিদি? বলুন, কার গ্যারান্টি? মোদী না দিদির?” তাঁর হুঁশিয়ারি, ‘‘ট্রেলার দেখাল জনগর্জন, এর পরে হবে বিরোধীদের বিসর্জন!’’
একশো দিনের কাজের প্রকল্পের পাওনা টাকা ইতিমধ্যেই দেওয়া শুরু করেছে রাজ্য সরকার। রাজ্যে ‘বঞ্চিত’ মানুষের সংখ্যা যে বিপুল, তা বোঝাতে গিয়ে মমতা এ দিন বলেছেন, ‘‘আমরা ভেবেছিলাম, যাঁদের টাকা আটকে দিয়েছে কেন্দ্র, সেই সংখ্যাটা ২৭ লক্ষ মতো হবে। পরে অভিষেকেরা শিবির খুলে সমীক্ষা করতে গিয়ে দেখেছে, ওটা ৫৯ লক্ষ!’’ একশো দিনের কাজের মতো আবাস যোজনাতেও তাঁর সরকার যে পদক্ষেপ করবে, সে কথাও ফের স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন মমতা। তাঁর ঘোষণা, ‘‘আমি ব্রিগেড থেকে বলে যাচ্ছি, যদি ১ মে-র মধ্যে না দেয়, ১১ লক্ষ লোকের বাড়ি আমরা তৈরি করে দেব। আমাদের সরকার থেকে কাজ হবে গরিব মানুষের জন্য।’’
কেন্দ্রের ‘বঞ্চনা’র অভিযোগকে সামনে এনে এবং রাজ্যের তরফেই টাকা দেওয়ার কথা বলে ‘মোদীর গ্যারান্টি’কে ফাঁপা দেখিয়েই যে তৃণমূল এ বার লোকসভা ভোটের ময়দানে নামছে, সেই কৌশল বারেবারেই স্পষ্ট হয়েছে ব্রিগেড থেকে। অভিষেক যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে শ্বেতপত্র দাবি করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তাঁর বক্তব্য, ‘‘কত টাকা ১০০ দিনের কাজে দিয়েছেন, কত টাকা আবাসে দিয়েছেন, তার শ্বেতপত্র প্রকাশ করুন। যদি না-ও পারেন, বিজেপির যে কোনও নেতা, কেন্দ্রীয় সরকারের যে কোনও অফিসারকে কলকাতায় পাঠাবেন। চ্যানেল, সঞ্চালক, সময় আপনি ঠিক করুন। দুধ কা দুধ, পানি কা পানি হয়ে যাবে!’’
তবে আসন্ন লোকসভা ভোট নিয়ে আশঙ্কার কথাও শোনা গিয়েছে মমতার গলায়। জাতীয় নির্বাচন কমিশনার অরুণ গয়ালের আচমকা ইস্তফার প্রসঙ্গ এনে তাঁর দাবি, ‘‘সংবাদপত্রে দেখলাম, বাংলায় যথেচ্ছ সন্ত্রাস, নানা এজেন্সি দিয়ে বাংলাকে জোর করে দখল করার যে চেষ্টা, এগুলো মানতে চাননি উনি। আমাদের সভা থেকে সেলাম জানাই!’’ তাঁর আরও মন্তব্য, ‘‘মনে রাখবেন, কেন্দ্র ভোটের নামে কলঙ্ক! কেন্দ্রের ভোট আর কেন্দ্রীয় সরকারই ভোট পরিচালনা করছে। নিজের ল্যাজ নিজেই কাটছে!’’
শিলিগুড়িতে প্রধানমন্ত্রীর সভা থেকেই প্রথম বার রাজনৈতিক মঞ্চে বক্তৃতা করেছেন সদ্য বিজেপিতে যোগ দেওয়া প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ বলে আক্রমণ করে তৃণমূলকে একটিও ভোট না দেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন তিনি। অভিজিতের নাম না করেই এ দিন মমতার পাল্টা তোপ, “ওঁদের মুখোশ তো দেখছেন, কেউটের থেকেও ভয়ঙ্কর! চেয়ারে বসেছিল কেউটে। বাইরে বেরিয়ে এসে গোখরো!” শিলিগুড়িতে মোদীর ওই সভায় প্রধানমন্ত্রীর হাতে মাথা ঠেকাতে দেখা গিয়েছিল অভিজিৎকে। মমতার ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য, “পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছে বাবু! এত দিন অনেক বিচার করেছা। হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর চাকরি খেয়েছো। এ বার তোমাদের বিচার হবে। জনগণ তোমাদের বিচার করবে।” অভিষেকও সঙ্গত করেছেন, ‘‘বিচারপতিরা অপরাধীদের সাজা দেন। এখন দেখা যাচ্ছে, চোর, দুর্নীতিগ্রস্তেরা গলায় উত্তরীয় পরিয়ে বিচারপতিকে স্বাগত জানাচ্ছে!’’
মমতা-অভিষেকের আক্রমণকে অবশ্য বিজেপি গুরুত্ব দিতে নারাজ। রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র ও সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যের কটাক্ষ, ‘‘এই সব কথার কোনও মূল্য আর বাংলার মানুষের কাছে নেই। বিসর্জনের আগে যেমন প্রতিমা নিয়ে শোভাযাত্রা হয়, ব্রিগেডের র্যাম্পে প্রার্থীদের নিয়ে হাঁটাও সে রকম!’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর প্রশ্ন, ‘‘যাঁরা গর্জন করছেন, তাঁদের বলতে চাই— বলছেন, আমি টাকা দিলাম। কেন্দ্র টাকা দিলে আপনাকে ১০০ দিনের মজুরির টাকা ব্যয় করতে হত না। চোর, ধর্ষণকারীদের বাঁচানোর জন্য সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছেন। কিন্তু যাদের আইনি অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে তাদের জন্য কেন আদালতে গেলেন না?’’ বিজেপি ও তৃণমূল, দু’পক্ষকেই বিঁধে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর মন্তব্য, ‘‘প্রতারকেরাই এখন সব চেয়ে বেশি জ্ঞান দিচ্ছে! যিনি দেশ বেচনেওয়ালা, সেই মোদীর গ্যারান্টির কী মানে আছে! রাজ্যের কৃষক, শ্রমিক, মহিলা, যুবক, চাকরি-প্রার্থীদের সর্বনাশ করেছেন যিনি, সেই মুখ্যমন্ত্রীর গ্যারান্টিরই বা কী মূল্য আছে!’’
বিরোধীদের কথায় আমল না দিয়ে দিনের শেষে মমতা অবশ্য তাঁর এক্স হ্যান্ড্লে দাবি করেছেন, ‘‘সমবেত জনতার গর্জনে বাংলা থেকে দিল্লি পর্যন্ত জমিদারের দল ভয়ে কাঁপছে! ব্রিগেডে জনতার সমর্থন দেখে আমার বিশ্বাস আরও বেড়ে গিয়েছে যে, জনগর্জনেই বিজেপির বিসর্জন হবে।’’ বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী পাল্টা কটাক্ষে বলেছেন, ‘‘আপনার প্রার্থী তালিকা অন্য কথা বলছে। যোগ্য প্রার্থীদের না পেয়ে বাইরে থেকে টোপ দিয়ে লোক আনতে হয়েছে! কয়েক মাসে কাদের বিসর্জন হয়, দেখা যাক!’’