—প্রতীকী চিত্র।
মঙ্গলবার লোকসভা ভোটের ফলপ্রকাশ। রানাঘাট লোকসভা নির্বাচনের ফলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সব মহল। নিজেদের হাতছাড়া হওয়া দুর্গ বিজেপি থেকে পুনরুদ্ধার করতে পারবে কিনা তৃণমূল, সেই প্রশ্নের পাশাপাশি বাম ভোট আদৌ কতটা নির্ণায়ক হবে রানাঘাটে, তারও উত্তর মিলবে। এমনকি, মতুয়া গড়ে এবারের ভোট পরীক্ষা নাগরিকত্ব আইনেরও। বিরোধী ভোট ভাগাভাগির পাশাপাশি মতুয়া ভোট কোন দিকে ঝুঁকছে, নাগরিকত্ব আইন নিয়ে উদ্বাস্তু জনপদগুলি কোন পথে হাঁটছে, তারও উত্তর দেবে রানাঘাটের ফল। এমনটাই মনে করছেন সকলে।
রানাঘাটের ফল এ বার অগ্নিপরীক্ষা সব দলের কাছেই। অগ্নিপরীক্ষা বিজেপি প্রার্থী জগন্নাথ সরকার এবং তৃণমূলের মুকুটমণি অধিকারীর কাছেও। গত বার বিপুল ভোটে রানাঘাট লোকসভায় জয়, তার পরে বিধানসভা ভোটে শান্তিপুরে দাঁড়িয়েও জিতে ছিলেন বিজেপির জগন্নাথ। তবে গত পাঁচ বছরে দলের মধ্যেই তাঁর বিরোধী সংখ্যাও বেড়েছে। বিভিন্ন সময় দলের অন্দরে বিরোধিতা প্রকাশ্যেও এসেছে। কোন্দলে জড়িয়েছে তাঁর নামও। এবারে ভোট তাই পরীক্ষা জগন্নাথের কাছেও। অন্য দিকে, সদ্য বিজেপি থেকে তৃণমূলে যোগ দিয়ে প্রার্থী হয়েছেন মুকুটমণি অধিকারী। দলবদলের পর এবারের ভোট মুকুটমণির কাছেও বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনের পরিসংখ্যান বলছে, রানাঘাট লোকসভায় পাঁচ বছর আগে বিপুল ব্যবধানে বিজেপি জয়ী হওয়ার পর বিধানসভা ভোটে রানাঘাটের সাতটি আসনের মধ্যে ছ’টিতেই জয়ী হয় বিজেপি। তবে সে বার বিজেপির ভোটের শতকরা হার কমে ছিল অনেকটাই। তুলনামূলক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল তৃণমূলের ভোট। বাম-কংগ্রেসের ভোট অবশ্য বৃদ্ধি হয়নি।
আবার, এই রানাঘাটে মতুয়া ভোট এক অন্যতম নির্ণায়ক শক্তি। এর আগের ভোটগুলিতে মতুয়ারা অনেকটাই বিজেপির দিকে ঝুঁকেছিলেন বলে মনে করা হয়। তবে বিজেপির অন্যতম মতুয়া-মুখ মুকুটমণিকে নিজেদের দলে টেনে সেই ভোট ব্যাঙ্কে অনেকটাই ধাক্কা দেওয়া যাবে বলে আশাবাদী তৃণমূল। আবার, রানাঘাট লোকসভার মধ্যেই কুপার্স, তাহেরপুর, ফুলিয়া, শান্তিপুরের মতো একাধিক জায়গা উদ্বাস্তু-অধ্যুষিত। সেখানেই বা নাগরিকত্ব আইন কতটা ছাপ ফেলল, তার পরীক্ষা এবারের ফল। উদ্বাস্তু জনপদ নাগরিকত্ব আইনকে সামনে রেখে কার দিকে ঝুঁকছে, ফল প্রকাশের আগে তারও হিসাব করছে সব পক্ষ। বিধানসভা ভোটে ভরাডুবি হলেও কয়েক মাস পরেই শান্তিপুর বিপুল ব্যবধানে জিতে বিজেপির থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল তৃণমূল। সেই শান্তিপুর এবার কাকে এগিয়ে দেবে, তারও উত্তর খোঁজার পালা। পুরভোটে অন্তত শান্তিপুর শহরে এ বার খাতা খুলেছে বিজেপি। পঞ্চায়েত ভোটেও শান্তিপুরে তারা তৃণমূলকে ধাক্কা দিয়েছে ভাল মতোই। আবার এই শান্তিপুর, চাকদহের বেশ কিছু জায়গা ভাঙন-কবলিত। ভাঙনের সমস্যা প্রতিরোধে বিজেপি-তৃণমূলের মধ্যে চাপানউতোর রয়েছে দীর্ঘ দিনের। একই রকম ভাবে শান্তিপুর, নবদ্বীপের একটি বড় অংশই তাঁত-শিল্প অধ্যুষিত। এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত বহু মানুষ। বিপন্ন এই শিল্প নিয়েও বিজেপি-তৃণমূলের মধ্যে লড়াই রয়েছে। দুই তরফেই এই সমস্ত জায়গার মানুষজনের মন জয়ের চেষ্টা রয়েছে অনেক আগে থেকেই।
এর পাশাপাশি রানাঘাট লোকসভায় রাজনৈতিক সমীকরণেও কিছু পরিবর্তন আনার লড়াই শুরু হয়েছে। সিপিএমও নিজেদের ভোট বৃদ্ধি করতে চায়। তারা এ বার সে ভাবেই ঝাঁপিয়েছে। সঙ্গে রয়েছে জোটসঙ্গী কংগ্রেস। এক সময়ে বিজেপির দিকে চলে যাওয়া ভোট ব্যাঙ্ক সিপিএম কতটা নিজেদের দিকে ফেরাতে পারল, তা উপরেও অনেক কিছু নির্ভর করবে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। সে ক্ষেত্রে বিরোধী ভোট ভাগাভাগির অঙ্কে তৃণমূল কিছু সুবিধা পাবে মনে করলেও অন্য অংশের দাবি, সিপিএম ভোট ব্যাঙ্ক বৃদ্ধি করলে তারা সংখ্যালঘু ভোটেও থাবা বসাবে। সে ক্ষেত্রে বেকায়দায় পড়তে পারে তৃণমূল।
একাধিক জায়গায় বিজেপির গোষ্ঠী কোন্দলের পাশাপাশি তৃণমূলের কোন্দল রয়েছে। আর তা কোথায় কতটা ছাপ ফেলে গেল, তারও হিসাব করার পালা এ বার। সব মিলিয়ে রানাঘাটের ফল অন্য রাজনৈতিক সমীকরণের পাশাপাশি আগামী দিনে মতুয়া থেকে শুরু করে উদ্বাস্তু, তাঁত শিল্প, ভাঙন কবলিত এলাকার ভোট ব্যাঙ্ক— কোন দিকে ঝুঁকতে চলেছে, তার ইঙ্গিত দিয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। ভোটের অঙ্কের হিসাব কষছে সব তরফ।
রানাঘাটের বিজেপি প্রার্থী জগন্নাথ সরকার বলেন, ‘‘পর পর কয়েকটি ভোটে তো রানাঘাটের মানুষ প্রমাণ করে দিয়েছেন, তাঁরা বিজেপির দিকে। কারও কোনও অঙ্কই আর কাজ করবে না।’’
আর তৃণমূলের রানাঘাট সংগঠনিক জেলা সভাপতি দেবাশীষ গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘বিজেপি রানাঘাটের মানুষকে ভুল বুঝিয়েছে এত দিন। সেটা মানুষ বুঝতে পেরেছেন। এবারের ভোটে মানুষ বিজেপিকে পাল্টা জবাব দেবেন।’’