—প্রতীকী চিত্র।
কেউ কথা রাখেনি!
কাব্যের কথা আলাদা। সেখানে ৩৩ বছর অপেক্ষায় থাকা যায়। কিন্তু বাস্তবে কিঞ্চিত উলটপুরাণ ঘটছে। বিশেষ করে, জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে। ভোটারেরা যাঁকে হাত উপুড় করে ভোট দিয়ে জিতিয়ে আনছেন, পাঁচ বছর, দশ বছর অপেক্ষার পরে তাঁর কাছ থেকে দাবি বা প্রত্যাশা মতো ‘প্রতিদান’ না পেলে তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেও দ্বিধা করবেন না।
একদা বামেদের ‘গড়’ ছিল উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা। কোথাও ফরওয়ার্ড ব্লক, কোথাও আরএসপি, কোথাও সিপিএম। সে সব ‘গড়’ এক দিনে তৈরি হয়নি। স্বাধীনতার আগে থেকে নানা আন্দোলনে এলাকার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল দলগুলি। শিকড় ছিল গভীরে। আর কংগ্রেসের প্রভাব তো ছিলই। ২০১১ সালে পরিবর্তনের সময়েও বিধায়কদের মধ্যে একাধিক দলের প্রতিনিধি ছিলেন। এর ঠিক তিন বছর পরে, ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের সময় প্রভাব বাড়িয়ে নেয় রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল।
কিন্তু দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, তার থেকে তৈরি ক্ষোভ ও সর্বোপরি ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার যন্ত্রণা ২০১৯ সালের ভোটবাক্সে প্রতিফলিত হয়। আটটি লোকসভার একটিও পায়নি তৃণমূল। গেরুয়া রঙে পুরো উত্তরবঙ্গ রেঙে উঠেছে। দার্জিলিং আসনটি সেই ২০০৯ সাল থেকে জিতছে বিজেপি। সেখানে রাজু বিস্তা রেকর্ড চার লক্ষেরও বেশি ভোটে জেতেন ২০১৯ সালে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই সাত জন সাংসদ পরবর্তীকালে উত্তরের আটটি জেলার জন্য কী করেছেন? জাতীয় সড়ক প্রকল্পের অধীনে যে রাস্তা তৈরি হচ্ছে, সেটি ছাড়া আর ঠিক কী করা হয়েছে? কেউ বলতেই পারেন, উত্তরবঙ্গে প্রথম বন্দে ভারত এক্সপ্রেস চালু হয়েছে। বালুরঘাটের জন্যও একটি নতুন ট্রেনের ব্যবস্থা করেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। আর? বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ‘বন্দে ভারত’ ছাড়া, যে ট্রেনগুলি উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন শহর থেকে রাজ্য ও দেশের বিভিন্ন শহরকে যুক্ত করছে, সেগুলির পরিষেবা দিন দিন খারাপ হয়। খারাপ হয় হাওড়া-এনজেপি শতাব্দী এক্সপ্রেসের পরিষেবাও। যে নতুন ‘বন্দে ভারত’ দেওয়া হয়েছে, তা নিয়েও মাঝে মাঝে অভিযোগ ওঠে।
পাহাড়ে দীর্ঘদিনের দাবি, ১১টি জনজাতিকে তফসিলি জনজাতির মর্যাদা দেওয়ার। চা বাগানে যেমন রাজ্য সরকারের প্রতি দাবি রয়েছে, ন্যূনতম মজুরি বাড়াতে হবে, তেমনই বন্ধ ও রুগ্ণ বাগান নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। চা শিল্প নিয়ে ঠিক কী-কী দাবি কেন্দ্রের থেকে পাশ করিয়ে এনেছেন আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ির দুই সাংসদ? সীমান্তবর্তী এলাকা প্রতি জেলায় রয়েছে। সেখানে বিএসএফকে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত এক্তিয়ার বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সমস্যা মেটেনি। বরং, সীমান্ত এলাকার অনেক গ্রামেই সীমান্ত রক্ষী বাহিনী নিয়ে নানা ক্ষোভ আছে।
জলপাইগুড়ি থেকে প্রথম এবং সম্ভবত সব থেকে বেশি অভিযোগ উঠেছিল একশো দিনের কাজে দুর্নীতি নিয়ে। বেশি কেন্দ্রীয় দলও সেখানেই এসেছে। তার পরে? একশো দিনের কাজই শুধু নয়, আবাস যোজনার টাকাও দু’বছর বন্ধ করে রাখা হয়েছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে। কেন্দ্রীয় দলের রিপোর্ট কী, কেন অপরাধীদের শাস্তি এবং আদত উপভোক্তাদের বেছে তাদের টাকা দেওয়া হচ্ছে না— এর জবাব কোনও সাংসদ দেননি। রাজ্য বিজেপি নেতারা বুঝিয়েছেন, তাঁরা ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত দুর্ভোগ চলবে।
ফল?
এত দিন ধরে উত্তরবঙ্গে তাদের ‘শক্ত’ ঘাঁটিরগুলির বেশিরভাগেই ভোট শতাংশ কমেছে বিজেপির। দার্জিলিঙে সম্ভবত সব থেকে বেশি। আট শতাংশ বিন্দু। সেখানে তৃণমূলের ভোট বেড়েছে ১১ শতাংশ বিন্দু। ভোট কমেছে অমিত শাহের প্রাক্তন ডেপুটি নিশীথ প্রামাণিকের কেন্দ্রে। প্রায় দুই শতাংশ বিন্দু। সেখানে তৃণমূলের ভোট বেড়েছে চার শতাংশ বিন্দুর বেশি। চা বলয়েও একাধিপত্য দেখাতে পারেনি বিজেপি। সুকান্তের কেন্দ্র বালুরঘাটে বিজেপির ভোট বেড়েছে ১.৪ শতাংশ বিন্দু। তৃণমূলের ভোট বেড়েছে পাঁচ শতাংশ বিন্দু। মালদহে তৃণমূলের ভোট কমেছে। বিধানসভা ভোটে সেখানে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের পরেও আশানুরূপ কাজ করতে পারেনি শাসক দল।
অর্থাৎ, ‘কাজ কর, ভোট নাও’। ভোটারদের এই মতামত গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে অত্যন্ত মূল্যবান। যাঁরা ভোট কমেও জিতে এলেন, তাঁদের সতর্ক হতে হবেই। যাঁদের ভোট বাড়ল, সতর্ক হতে হবে তাঁদেরও। কাজ না করে কথার কৌশলে যে পার পাওয়া যাবে না, সেটা উত্তরবঙ্গের মানুষ স্পষ্ট করে দিয়েছেন।