মগরাহাট স্টেশন। —ফাইল চিত্র।
দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়েও ভোট দেওয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত শুনতে হয়েছিল, ‘‘ভোট পড়ে গিয়েছে, বাড়ি যান।’’ অনেকে ভোটের লাইনে পর্যন্ত পৌঁছতেই পারেননি। তার আগেই তাড়া খেয়ে ফিরে যেতে হয়েছিল। শাসকদলের বিরুদ্ধে বোমাবাজি, ছাপ্পা ভোট, সন্ত্রাসের এমন একাধিক অভিযোগকে ঘিরে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল বছরখানেক আগে পঞ্চায়েত ভোটে। জয়নগর লোকসভার অধীন মগরাহাট পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্রের বহু মানুষের মনে সেই স্মৃতি টাটকা। আসন্ন লোকসভা ভোটে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে কি না, সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তাঁদের মনে। নির্বাচন কমিশনের শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের আশ্বাস দিয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। তারপরেও ভরসা পাচ্ছেন না বহু ভোটার।
গত পঞ্চায়েত ভোটে ব্যাপক সন্ত্রাসের অভিযোগ ওঠে ধনপোতা, কলস, মগরাহাট পশ্চিম পঞ্চায়েত এলাকায়। স্থানীয় বাসিন্দা কুদ্দুস মোল্লার অভিযোগ, “পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে আমরা বুথের ধারেকাছে ঘেঁষতে পারি। অনেককে তো লাইনে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়েও শুনতে হয়েছে, ভোট পড়ে গিয়েছে। এ বারও ভোট দিতে পারব কি না, জানি না। কেন্দ্রীয় বাহিনী এলাকায় রুট মার্চ করে গিয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসন।” অনেকেরই দাবি, এর মধ্যেই ভোট দেওয়া নিয়ে শাসকদলের হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে।
মগরাহাট পশ্চিম কেন্দ্রে ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে ১৮ হাজার ভোটে জিতেছিল তৃণমূল। ২০২১ সালের বিধানসভায় তিনগুণ বেড়ে তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান দাঁড়ায় প্রায় ৫৪ হাজার। শাসকদল জোরজুলম করেই এত ভোট পেয়েছিল বলে অভিযোগ বিরোধীদের। সে কথা মানেননি তৃণমূ নেতৃত্ব।
২০০৭-০৮ সাল থেকে তৃণমূল মগরাহাট ২ ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতি ও কিছু পঞ্চায়েতের দখল নেয়। তারপর থেকেই ধীরে ধীরে তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয় মগরাহাট। বাম জমানার শেষের দিকে ২০১১ সালে মগরাহাটের নৈনানপুর গ্রামে বিদ্যুৎ লাইনের হুকিং-কাণ্ডে পুলিশের গুলিতে এক গ্রামবাসী মারা যান। গ্রামবাসীর ছোড়া পাথরে পুলিশকর্মীর মৃত্যু হয়েছিল। তা নিয়ে দীর্ঘ রাজনৈতিক চাপানউতোর চলে। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে ২০১২ সালে বিষ মদ-কাণ্ডে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এখানে।
তৃণমূল ক্ষমতা দখলের পর থেকে যত দিন এগিয়েছে, দলে কোন্দল বেড়েছে। অনেকেই দল থেকে বসে গিয়েছেন বলে অভিযোগ। বিধায়ক থেকে পঞ্চায়েত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ নিয়েও ভুরি ভুরি অভিযোগ রয়েছে।
২০১১ সাল থেকে টানা তিন বার এই বিধানসভায় জিতেছেন নমিতা সাহা। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপোষণের অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা। অভিযোগ, তাঁর এক সময়ের ছায়া সঙ্গীদের আজকাল আর মঞ্চে, সভায় দেখা যায় না। পুরনো নেতৃত্বকে বসিয়ে নতুন ‘অযোগ্য’দের হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ আছে দলের অন্দরে। এক সময়ে তৃণমূলের পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, সহ-সভাপতির পদ সামলানো খইরুল হককে দুর্নীতির প্রতিবাদ করায়, বসিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। ক’দিন আগে পুরনো দল কংগ্রেসে ফিরেছেন খইরুল।
তৃণমূলের বিরুদ্ধে এই ক্ষোভেরই সুবিধা নিতে চাইছে বিরোধীরা। প্রায় ৫৫ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় বর্তমানে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। গত পঞ্চায়েত, বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমকে সরিয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করে বিজেপি। তবে রাজনৈতিক মহলের মতে, বিজেপির কর্মী সমর্থক থাকলেও রাজ্য ও জেলা নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। ফলে সে ভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারছে না পদ্মশিবির। তা ছাড়া, বুথস্তরে সে ভাবে সভা-সমিতিও হচ্ছে না বলে জানালেন দলেরই অনেকে।
তবে বিজেপি নেতা চন্দনকুমার নস্কর বলেন, “আমরা স্থানীয় নেতৃত্ব নিয়মিত বুথভিত্তিক বৈঠক
করছি। কর্মীদের মনোবল বেড়েছে।” সংগঠনিক শক্তির কিছুটা
ঘাটতি রয়েছে বলে যদিও মেনে নেন তিনি।
মগরাহাট ব্লকের সিপিএম নেতা চন্দন সাহা বলেন, “তৃণমূলের দুর্নীতির জেরে পুরনো অনেকে আমাদের দলে ফিরছেন। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে আগের থেকে আমাদের ভোট বাড়বে।” এ বার বামেদের তরফে জয়নগর লোকসভায় লড়ছেন আরএসপি প্রার্থী। তাঁকে সমর্থন জানিয়েছে কংগ্রেস। তবে কংগ্রেস কর্মীদের প্রচারে সে ভাবে দেখা যাচ্ছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কংগ্রেস নেতা বলেন, “এখনও পর্যন্ত কোনও মিছিল,মিটিংয়ে যাইনি। যাব কি না, তা-ও বলতে পারছি না।”
তৃণমূল বিধায়ক নমিতা সাহা বলেন, “কোনও দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, সন্ত্রাস হয়নি। বিরোধীরা মিথ্যা বদনাম রটাচ্ছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপিই এলাকায় সন্ত্রাস চালিয়েছে। সারা রাজ্যের মধ্যে এই কেন্দ্রে সব থেকে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়।”