—প্রতীকী চিত্র।
বছরখানেক আগের এক দুপুর। অন্নপূর্ণা পুজোর ভাসান সংক্রান্ত গোলমালকে কেন্দ্র করে বাগুইআটির ফয়রা ভবন এলাকায় একটি পরিবারের একাধিক জনকে মারধরের অভিযোগ ওঠে স্থানীয় একটি ক্লাবের সদস্যদের বিরুদ্ধে। রেয়াত করা হয়নি ওই বাড়ির মহিলাদেরও। মারধরের সেই ঘটনার পরে ক্লাবের সদস্যদের প্রকাশ্যেই শাসকদলের এক নেতার কথা বলতে শোনা যায়। তার পরে অভিযুক্তেরা এলাকায় অবাধে ঘুরে বেড়ানো সত্ত্বেও পুলিশ তাদের ‘খুঁজে পাচ্ছে না’ দেখে স্থানীয় বাসিন্দারা বুঝে যান যে, ওই নেতার হাতই ক্লাবের মাথায় রয়েছে। অন্যান্য ভোটের মতো লোকসভা ভোটের আগেও ক্লাবের সদস্যেরা নেতার দিকে আনুগত্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
আবার দক্ষিণ দমদম এলাকার একটি ক্লাবের এক পদাধিকারীকে এক জন জনপ্রতিনিধি রীতিমতো হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছেন, ‘ভোট করতে’ না পারলে এলাকায় নির্মাণ সামগ্রী ফেলার সিন্ডিকেট থেকে তাঁকে বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। জনশ্রুতি, শাসকদলের নেতাদের একাংশের উপরে ক্ষুব্ধ হয়ে ওই ক্লাবকর্তা দলীয় কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছিলেন না। তিনিও আবার সক্রিয় হয়েছেন।
লোকসভা নির্বাচনের দিন ঘোষণা হওয়ার পরেই বিভিন্ন জায়গায় চনমনে হয়ে উঠেছে পাড়ার ক্লাবগুলি। সারা বছর পুজো, জলসা, রক্তদান শিবিরের মতো কর্মসূচিতে নেতারা ক্লাবের পাশে দাঁড়ান। সময় মতো মেলে সরকারি অনুদানও। ক্লাবের তরুণ সদস্যেরা এলাকায় নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহের বরাত পেয়ে রোজগার করেন। তাই ভোটের সময়ে নেতার পাশে দাঁড়ানোটাই দস্তুর— এমনই দাবি বিভিন্ন ক্লাবের। দমদমের আর এন গুহ রোডের একটি ক্লাবের এক কর্মকর্তার কথায়, ‘‘সারা বছর আমাদের। একটা দিন তো ওঁর জন্য আমাদের থাকতেই হবে।’’
আপাতত নেতাদের সেই ‘এক দিনের খেলা’র মাঠই প্রস্তুত করছে বিভিন্ন ক্লাব। ভোটের প্রচার থেকে শুরু করে ভূতুড়ে ভোটারের খোঁজ, সবই করছে ক্লাবগুলি। বাগুইআটির সাহাপাড়া এলাকার একটি ক্লাব বর্তমানে এক নেতা ও তাঁর লোকজনের প্রায় ঘরবাড়ি হয়ে গিয়েছে। এমনকি, সেখানে এলাকার বাইরের ছেলেদের এনেও পরিচয় করানো হচ্ছে। যাতে ভোটের দিন ‘গুছিয়ে’ ভোট করতে গিয়ে পাড়ার ছেলেদের ভাবমূর্তির উপরে বিশেষ প্রভাব না পড়ে।
নির্বাচনী রাজনীতিতে ক্লাবের সক্রিয়তার কথা মেনে নিয়ে তৃণমূলের বর্ষীয়ান সাংসদ সৌগত রায় বলেন, ‘‘এটা ঠিকই যে, ক্লাবগুলি রাজ্য সরকারের অনুদান পায়। বহু নেতাই এই ধরনের ক্লাবের সঙ্গে জড়িত। তাঁদের নেতৃত্বে ক্লাবগুলি ভোটে অংশ নেয়। তবে, ক্লাব কখনও সরাসরি সিন্ডিকেট চালায় না। এখন কেউ সিন্ডিকেটের সদস্য হয়ে ক্লাবের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন।’’ বারাসত, বাগুইআটি, দমদম, রাজারহাটের পাশাপাশি সুকান্তনগর ও নয়াপট্টির মতো সল্টলেকের সংযুক্ত এলাকার অনেক ক্লাবের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, সেগুলি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কতটা জড়িত। কোথাও শাসকদলের রাজ্য স্তরের নেতাদের ছবি, কোথাও আবার সর্বোচ্চ নেতৃত্বের। সঙ্গে অবশ্যই থাকে এলাকার স্থানীয় নেতার ছবি।
কোনও রকম বৈধ নকশা ছাড়াই তৈরি হওয়ায় সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে একটি ক্লাব ভেঙে দিয়েছে বিধাননগর পুরসভা। বিধাননগরের এক পুরপ্রতিনিধির সভাপতিত্বে চলা সেই ক্লাবের উপরে তাঁর বিরাট কাট-আউট ঝুলত। এক সময়ে শাসকদলের বিশিষ্ট নেতারা গিয়ে ক্লাবটির উদ্বোধন করেছিলেন। গত বিধানসভা ভোটেও ওই ক্লাব প্রবল সক্রিয় ছিল। আবার
বারাসতের বামুনমুড়োয় টাকি রোডের ধারের একটি ক্লাব ঘিরে এলাকায় গুঞ্জনের অন্ত নেই। বারাসত লোকসভা কেন্দ্রের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতার হাত রয়েছে সেই ক্লাবের মাথায়। সদ্য গজিয়ে ওঠা ক্লাবটি মাটি কাটা, মাটি ফেলা, জমির দালালি, নির্মাণ সামগ্রী ফেলা-সহ নানা কাজের নিয়ন্ত্রক। এমনকি, স্থানীয় পানশালাতেও ক্লাবের সদস্যদের বিশেষ ছাড় রয়েছে বলে খবর।
সিপিএমের বর্ষীয়ান নেতা তন্ময় ভট্টাচার্যের ব্যাখ্যা, ‘‘এক সময়ে পাড়ার ক্লাবে নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। পুজো হত। বেকারত্বের যুগে সিন্ডিকেট, তোলাবাজির মতো রোজগারের বিকল্প পথ দেখিয়ে তৃণমূল কিংবা বিজেপির মতো দলগুলি ক্লাবের তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতির কাজে ব্যবহার করছে। বাংলায় এক কুসংস্কৃতির সূচনা করেছে ওরা।’’
বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের মতে, সারা বছর এত রকম সুবিধা পেলে ভোটের সময়ে ক্লাবগুলি তো নিজেদের উজার করে দেবেই। তাঁরা জানান, আজকাল পাড়ার ক্লাবে পুজোর সময়ে নাটক করার লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ, সন্ধ্যার পরে ক্লাব জমজমাট থাকে। ভেসে আসে ক্যারম খেলার শব্দ, নয়তো বিরাট স্ক্রিনের এলইডি টিভির আওয়াজ। নেতারা ভোটের সময়ে ক্লাবের মাঠে এসে ব্যাট হাতে কিংবা ফুটবল পায়ে ছবি তোলেন। ক্লাবে ফুটবল, ক্যারম খেলা হয়। ক্লাবের মাঠে ঝলমলে আলো জ্বলে। সবের পিছনেই রয়েছে নেতাদের হাতযশ। তাই ভোটের সময়ে তিনি তো হিসাব বুঝে নেবেনই।