ইউসুফ পাঠান এবং হুমায়ুন কবীর। —ফাইল চিত্র।
ভোট মিটতেই দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে বহরমপুরে। দলের নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে ইউসুফ পাঠানের ‘লিড’ আশানুরূপ হবে না বলে আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন হুমায়ুন কবীর। এ বার ভরতপুরের বিধায়ক সরাসরি দুষলেন মুর্শিদাবাদ সাংগঠনিক জেলা তৃণমূলের সভাপতি অপূর্ব সরকারকে। জেলার রাজনীতিতে যিনি ডেভিড বলে সমধিক পরিচিত। হুমায়ুনের দাবি, ‘হিন্দু ভোট’ ধরে রাখতে পারেননি অপূর্ব! ইউসুফের জয়ের ব্যাপারে একশো শতাংশ নিশ্চিত হলেও বিধায়কের বক্তব্য, ‘হিন্দু ভোট’ ঝুলিতে আশানুরূপ না-আসায় দলীয় প্রার্থীর জয়ের ব্যবধান কমবে। এ রকম সত্যিই ঘটলে অপূর্বের জেলা সভাপতি পদে থাকা উচিত নয় বলেও মন্তব্য করেন হুমায়ুন।
দলীয় বিধায়কের এই মন্তব্য নিয়ে অপূর্ব অবশ্য বিশেষ কিছু বলতে চাননি। তিনি বলেন, ‘‘ব্যক্তিগত স্তরে কে কী বলছেন, তা নিয়ে দলীয় প্ল্যাটফর্ম থেকে মন্তব্য করা ঠিক নয়। এ বিষয়ে কোনও মন্তব্যই করব না।’’
বহরমপুরে ইউসুফের জয় নিশ্চিত করতে হুমায়ুনকে ‘বিশেষ দায়িত্ব’ দিয়েছিলেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল সূত্রে খবর, ভোটের পর দলীয় বৈঠকে বিধায়ক দাবি করেছেন, নেত্রীর ‘বিশেষ দায়িত্ব’ দেওয়া জেলা নেতৃত্বের একাংশ ভাল চোখে দেখেননি। গোসা হয়েছিল দলের এক শ্রেণির। তাঁরাই অন্তর্ঘাত করেছেন! এর প্রেক্ষিতে হুমায়ুনের সঙ্গে যোগাযোগ করে আনন্দবাজার অনলাইন। তাঁর বক্তব্য, প্রত্যাশিত ব্যবধানের থেকে অনেক কম ব্যবধানে জিতবেন ইউসুফ। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিধায়কের যুক্তি, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বিশেষ দায়িত্ব দেওয়ার পর আমি ইউসুফের হয়ে সর্বোচ্চ পরিশ্রম করেছি। ইউসুফ অরাজনৈতিক লোক। রাজনৈতিক প্যাঁচ উনি বোঝেন না। সেই সুযোগে অনেকেই ওঁকে ভুল বুঝিয়ে বহরমপুরে দলের ক্ষতি করেছেন।’’
হুমায়ুন দাবি করেছেন, বাড়তি দায়িত্ব পাওয়ায় তাঁকে সে ভাবে সহযোগিতা করেননি অপূর্ব। তাঁর অভিযোগ, ভরতপুরে দলের ফেস্টুন, ব্যানারে তাঁর ছবিও ব্যবহার করা হয়নি। তাঁর কথায়, ‘‘ভরতপুরে অপূর্বদার নির্বাচন কমিটি তৈরি করার কথা ছিল। সেখানে আমার লোকেদের বাদ দিয়ে ইচ্ছাকৃত ভাবে পুরনো কমিটিকে বলবৎ করেছিলেন উনি। জেলার সংখ্যালঘু মানুষদের ভোট ধরে রাখতে আমি একাংশের রোষের স্বীকার হয়েছি। অপূর্বদা হিন্দু ভোট ধরে রাখতে পারেনি। নিজের সম্প্রদায়ের ভোট ধরে রাখার যাঁর ক্ষমতা নেই, তাঁর পথ আঁকড়ে থাকার কী কারণ বুঝতে পারি না!’’ তবে হুমায়ুন বলেন, ‘‘ব্যবধান কম হলেও ইউসুফই জিতবেন।’’
গত লোকসভা নির্বাচনে বহরমপুরে কংগ্রেসের অধীর চৌধুরীর জয়ের মার্জিন অনেকটাই কমিয়ে দিতে পেরেছিল তৃণমূল। সে বার অধীরের বিরুদ্ধে শাসকদল নামিয়েছিল একদা তাঁর ‘ডান হাত’ অপূর্বকে। ২০১৪ সালে অধীরের তিন লাখে ভোটে জয়ের ব্যবধান এক ধাক্কায় ৮০ হাজার ৬৯৬ ভোটে এসে ঠেকেছিল। এ বার তৃণমূল আরও কৌশলী হয়ে প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার ইউসুফকে প্রার্থী করে। উদ্দেশ্য ছিল একটাই— সংখ্যালঘু ভোটারকে কাছে টানা। তৃণমূল সূত্রে খবর, এর মূল দায়িত্বই ছিল হুমায়ুনের কাঁধে। ঘটনাচক্রে, হুমায়ুন নিজেই ভোটের পর সংশয় প্রকাশ করেছেন যে, তাঁর নিজের বিধানসভা কেন্দ্র ভরতপুর থেকে ইউসুফকে আশানুরূপ ‘লিড’ দিতে পারবেন না। বিধায়কের কথায়, “আমি আমাদের দলের প্রার্থী ইউসুফ পাঠানকে যে পরিমাণ লিড দেওয়ার কথা বলেছিলাম, সেটা পূরণ হবে বলে মনে হচ্ছে না।” মঙ্গলবার হুমায়ুন দাবি করেছিলেন, গত পঞ্চায়েত ভোটের সময় এলাকায় প্রার্থী দেওয়াকে কেন্দ্র করে দলের মধ্যে যে বিভাজন দেখা দিয়েছিল সেটা এখনও ঠিক হয়নি। ভোটের কারণে সকলে মিলে সভায় পাশাপাশি বসে সভা করা হলেও মনের মিল হয়নি। এ বার বিধায়ক সরাসরি জেলা সভাপতিকে নিশানা করায় দলের একাংশ শঙ্কিত, ইউসুফ আদৌ জিতবেন তো?
প্রকাশ্যে কেউ কিছু না বললেও হুমায়ুনের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে ডেভিড-ঘনিষ্ঠদের একাংশের বক্তব্য, শীর্ষ নেতৃত্ব ইউসুফকে প্রার্থী করার পর হুমায়ুনই তো বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। ফলে অন্তর্ঘাত নিয়ে তাঁর কম কথা বলাই ভাল! এক নেতার কথায়, ‘‘অন্যের দিকে আঙুল তোলার আগে উনি নিজের কাজটা মন দিয়ে করতে পারতেন। উনি তো নিজেই বলেছেন যে ভরতপুর থেকে প্রত্যাশিত লিড দিতে পারবেন না। এখন অপূর্ব সরকারকে দোষারোপ করার কী মানে! অপূর্বদা কী করেছেন, তা ভোটের ফলেই বোঝা যাবে।’’
প্রসঙ্গত, ইউসুফকে দল প্রার্থী করার এক দিন পরেই প্রকাশ্যে মুখ খুলেছিলেন হুমায়ুন। সেই সময় তিনি দাবি করেছিলেন, “বহরমপুর কেন্দ্রে কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরীকে পরাজিত করতে হলে গায়ক বা খেলোয়াড় প্রার্থী দিয়ে কিছু হবে না। এখানে পোক্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিকেই প্রার্থী করতে হবে।” দলের রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গিয়ে এমন মন্তব্য করার পরে তিনি স্পষ্ট ভাবে জানিয়েছিলেন, “দলের কোনও মন্ত্রীর সঙ্গে নয়, দলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অথবা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করে আশানুরূপ ইঙ্গিত পেলে তবেই ইউসুফকে প্রার্থী হিসাবে মানব।” পরে বৈঠকও হয়েছিল এবং ইউসুফের হয়ে এলাকায় প্রচার করা থেকে সভা, সমস্ত কিছুই করেছেন হুমায়ুন। এমনকি ভরতপুর কেন্দ্রের ভরতপুর ১ ও ২ ব্লক তৃণমূলের দু’জন সভাপতির সঙ্গে মনোমালিন্য থাকার পরেও, তিনি শুধু দলনেত্রীর কথায় ইউসুফের হয়ে ভোট করার জন্য বার বার ছুটে গিয়েছেন দু’জন ব্লক সভাপতির কাছে। কিন্তু তাতেও কাজের কাজ কতটা হয়েছে, ভোটের পর এখন এই দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখে সেই প্রশ্ন তুলছেন তৃণমূলের একাংশ। ।