লোকসভার তৃতীয় দফার ভোটে গন্ডগোল বেধেছিল বিক্ষিপ্ত ভাবে। ছবি: পিটিআই ।
লোকসভার তৃতীয় দফার ভোটে অশান্ত মুর্শিদাবাদ। বিক্ষিপ্ত ভাবে গন্ডগোল বেধেছিল জঙ্গিপুর এবং মালদহের দুই কেন্দ্রেও। চার কেন্দ্রের অনেকগুলি বুথে বাম-কংগ্রেস প্রার্থীদের মারধরের অভিযোগ ওঠে শাসকদল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। মালদহ দক্ষিণে আক্রান্ত হন খোদ শাসকদলের কর্মীরাই। তবে বেলা বাড়তে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। মঙ্গলবার প্রার্থীদের হাতাহাতির সাক্ষীও থাকল বাংলার তৃতীয় দফা চার কেন্দ্র মিলিয়ে একাধিক ভুয়ো ভোটার চিহ্নিত করে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়। ভগবানগোলার উপনির্বাচনে গন্ডগোলের তেমন কোনও খবর পাওয়া যায়নি। বিকেল ৫টা পর্যন্ত মালদহ উত্তরে ভোট পড়েছে ৭৩.৩০ শতাংশ। মালদহ দক্ষিণে ভোট পড়েছে ৭৩.৬৮ শতাংশ। জঙ্গিপুরে ভোট পড়েছে ৭২.১৩ শতাংশ এবং ওই সময়ের মধ্যে মুর্শিদাবাদে ভোট পড়েছে ৭৬.৪৯ শতাংশ। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, বিকেল ৫টা পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের চার কেন্দ্রে সামগ্রিক ভোটদানের হার ৭৩.৯৩ শতাংশ। ভগবানগোলা উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে ৭৩.৬৮ শতাংশ। লোকসভা নির্বাচনের তৃতীয় দফায় চার কেন্দ্র মিলিয়ে বিকেল পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের কাছে মোট ৪৩৩টি অভিযোগ জমা পড়েছে। দলগত ভাবে অভিযোগ জমা পড়েছে ২৫৩টি। যার মধ্যে সিপিএমের অভিযোগ সব থেকে বেশি, ১৬৩টি।
মঙ্গলবার সকাল থেকেই উত্তপ্ত ছিল মুশির্দাবাদের পরিস্থিতি। ভোটগ্রহণ শুরুর আগেই ডোমকলে কংগ্রেস সমর্থকের বাড়ি লক্ষ্য করে বোমাবাজির অভিযোগ ওঠে তৃণমূল সমর্থকদের বিরুদ্ধে। কয়েকটি বুথে শাসকদলের কর্মীদের বিরুদ্ধে বাম-কংগ্রেস এজেন্ট এবং ভোটারদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। মুর্শিদাবাদের কোনও কোনও বুথে রাজ্য পুলিশের উপস্থিতির অভিযোগও উঠে এসেছিল মঙ্গলবার সকালে। তবে বেলা বাড়তেই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে আসে।
মঙ্গলবার সকাল থেকেই নিজের কেন্দ্রে সক্রিয় থাকতে দেখা গিয়েছিল মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী মহম্মদ সেলিমকে। রানিনগর ৩৪ বুথে সিপিএমের এজেন্টকে মারধর করে বার করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। মার খেয়ে কলাবাগানে লুকিয়ে ছিলেন ওই এজেন্ট। পরে সেলিম এসে তাঁকে উদ্ধার করেন। মুর্শিদাবাদের গোপীনাথপুরে ৩৬ নম্বর বুথে এক ভুয়ো এজেন্টকেও হাতেনাতে ধরে ফেলেন বাম প্রার্থী। এর পর গ্রামের ভিতর ঘুরে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করেন। ভোটারদের আশ্বস্ত করেন ভোট দিতে যাওয়ার জন্য। সেলিম কিছুটা যেতেই তাঁকে ঘিরে ‘গো ব্যাক’ স্লোগান ওঠে। তৃণমূল কর্মীদের একাংশ এই স্লোগান দেন। শাসকদলের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে সেলিমকে ধাক্কাধাক্কি করতেও দেখা যায়। অন্য দিকে, হিটলার সরকার নামে এলাকার এক তৃণমূল কর্মীর অভিযোগ, সেলিম তাঁকে মারধর করেছেন। তাঁর কথায়, “সেলিম আমায় মেরেছেন। আমার কলার ধরে টেনেছেন। ওঁকে গ্রেফতার করতে হবে। সাংবাদিকদের সামনে গায়ে হাত তুলেছেন। আমি মিথ্যে বলছি না।”
ভোটের সকালে উত্তপ্ত হতে দেখা গিয়েছিল মালদহ দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রও। এই লোকসভার অধীনে ইংরেজবাজার পুর এলাকায় বিজেপি প্রার্থী শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরীর সঙ্গে তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়েন তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা। আঙুল উঁচিয়ে তেড়ে যেতে দেখা যায় শ্রীরূপাকে। পাল্টা স্লোগান দিতে থাকেন তৃণমূল কর্মীরা। সব মিলিয়ে সাতসকালেই উত্তেজনা মালদহে। শ্রীরূপার অভিযোগ, তৃণমূলের প্রবীণ নেতা তথা ইংরেজবাজার পুরসভার চেয়ারম্যান কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রী কাকলি ভোটকেন্দ্রের সামনে জমায়েত করে ভোটারদের প্রভাবিত করছেন। পাল্টা কৃষ্ণেন্দুর অভিযোগ, বিজেপি প্রার্থী নিজেই রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরে ভোটকেন্দ্রের ভিতরে ঢুকে নিজেকে ভোট দেওয়ার আবেদন করছেন। ওই বুথ ছাড়াও একাধিক বুথে গিয়ে তৃণমূল কর্মীদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন শ্রীরূপা।
মঙ্গলবার দুপুরে মালদহ দক্ষিণে আক্রান্তও হয়েছেন শাসকদলের কর্মীরা। এমনটাই দাবি তৃণমূলের। সুজাপুরে একটি বুথ থেকে বার করে তৃণমূল এজেন্ট-সহ তিন তৃণমূল কর্মীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ, আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে বাঁশ দিয়ে মারধর করা হয় তাঁদের। আহতদের মালদহ মেডিক্যাল কলেজের একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন তৃণমূল প্রার্থী শাহনওয়াজ আলি রাইহান। পাশাপাশি, মালদহ দক্ষিণের শমসেরগঞ্জের জোতশালীর ১২৫ এবং ১২৬ নম্বর বুথে অশান্তি বাধানোর অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ভোট দিতে আসা এক বৃদ্ধ কংগ্রেস সমর্থকের পা ভেঙে দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ। ২১৯ নম্বর বুথেও কংগ্রেসের উপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ, রোমি শেখ এবং জাভা শেখ নামে দুই এজেন্টের মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে শাসকদল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা। তাঁদের জঙ্গিপুর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
জঙ্গিপুর কেন্দ্রে তৃণমূল নেতার সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন খোদ বিজেপি প্রার্থী ধনঞ্জয় ঘোষ। অজগরপাড়া ৮৮ নম্বর বুথে ঘটনাটি ঘটে। ওই বুথে ধনঞ্জয়ের বিরুদ্ধে ভোটারদের প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ তোলেন রঘুনাথগঞ্জ ১ তৃণমূলের ব্লক সভাপতি গৌতম ঘোষ। এর পরেই দু’জনের মধ্যে বচসা শুরু হয়। প্রকাশ্যেই তৃণমূল নেতা গৌতমকে ধাক্কা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে ধনঞ্জয়ের বিরুদ্ধে। অন্য দিকে, পদ্মশিবিরের অভিযোগ, বিজেপি প্রার্থীকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করেন গৌতম। পরে তাঁর উপর চড়াও হন। এলোপাথাড়ি ভাবে মারধরের চেষ্টাও নাকি করেন। এই ঘটনায় পরস্পরের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছে তৃণমূল এবং বিজেপি।
মালদহ উত্তর কেন্দ্র মোটের উপর শান্ত থাকলেও অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে চাঁচলে। বোমা মারার হুমকি দিয়ে বিজেপির সহায়তা ক্যাম্প তুলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, মতিহারপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ধুমসাডাঙি ২২১ নম্বর বুথে বিজেপির ক্যাম্প তুলে দেওয়ার হুমকি দেন স্থানীয় তৃণমূল নেতা বাবু সরকার। বিজেপি কর্মী শঙ্কর দাসের অভিযোগ, বুথ থেকে এক কিলোমিটার দূরে বটগাছের তলায় ক্যাম্প করেছিলেন তাঁরা। তখনই বাবু সদলবলে এসে বোমা মারার হুমকি দেন বলে অভিযোগ। তবে সেই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি তৃণমূল নেতা বাবুর। এ ছাড়াও কয়েকটি বুথে বিক্ষিপ্ত ভাবে গোলমালের অভিযোগ উঠলেও পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর মধ্যস্থতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
তবে মালদহ দক্ষিণ কেন্দ্রের মোথাবাড়ির হামিদপুরে কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধেই অভিযোগ ওঠে। শাসকদলের অভিযোগ, ভয় দেখিয়ে এবং ভোটারদের প্রভাবিত করে বিজেপিকে ভোট দিতে বাধ্য করেছেন বাহিনীর জওয়ানেরা।
রাজ্যের চার কেন্দ্রে লোকসভা নির্বাচনের পাশাপাশি ভগবানগোলা বিধানসভায় উপনির্বাচনও ছিল মঙ্গলবার। তৃণমূল বিধায়ক ইদ্রিস আলির মৃত্যুতে ভগবানগোলা কেন্দ্রটিতে উপনির্বাচন হচ্ছে। ভগবানগোলায় তৃণমূল প্রার্থী করেছে স্থানীয় নেতা রেয়াত হোসেন সরকারকে। ভোটের হাওয়ার ইঙ্গিত, মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রের প্রার্থী সিপিএমের মহম্মদ সেলিমের আকর্ষণে ভগবানগোলা বিধানসভায় সুবিধা পেতে পারেন কংগ্রেস প্রার্থী আঞ্জু বিবি। বিজেপি ওই বিধানসভায় প্রার্থী করেছে এলাকার এক মণ্ডল সভাপতি ভাস্কর সরকারকে। তবে ওই বিধানসভায় সে ভাবে গন্ডগোলের কোনও খবর মেলেনি।