—প্রতীকী চিত্র।
বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভার মধ্যে সব থেকে বেশি মতুয়া এবং উদ্বাস্তু সমাজের মানুষ বাস করেন বাগদায়। স্বাভাবিক ভাবেই নাগরিকত্বের বিষয়টি এখানে ভোটে জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। সিএএ-র প্রভাব কী ভাবে পড়ে মতুয়াদের মধ্যে, তা নিয়ে কৌতূহল আছে নানা মহলে।
মতুয়া ভোট এখানে গুরুত্বপূর্ণ বরাবরই। মতুয়া উদ্বাস্তু মানুষের দীর্ঘ দিন দাবি নাগরিকত্ব। সম্প্রতি কেন্দ্র সিএএ (নাগরিকত্ব সংশোধিত আইন) কার্যকর করার বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। তারপর থেকে মতুয়া সমাজ কার্যত দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছেন। এক দল এতে খুশি। আবার এক দলের দাবি, তাঁরা নিঃশর্ত নাগরিকত্ব চেয়েছিলেন। কিন্তু সিএএ-তে নিঃশর্ত নাগরিকত্বের ব্যবস্থা নেই। আবেদনের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের কথা উল্লেখ আছে। ফলে তাঁরা সিএএ বাতিলের দাবি তুলেছেন।
তৃণমূলের পক্ষ থেকে আবার ভোট প্রচারে এই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, নাগরিকত্বের আবেদন করলে মতুয়া উদ্বাস্তু মানুষের এ দেশের পরিচয়পত্রগুলি বাতিল হয়ে যাবে। সরকারি প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হবে। বিজেপির থেকে পাল্টা প্রচারে তুলে ধরা হচ্ছে, ১৯৭১ সালের পরে যে সব উদ্বাস্তু মানুষ এ দেশে এসেছেন, তাঁদের নাগরিকত্বের আবেদন করতে হবে। কারণ, ইন্দিরা গান্ধী এবং শেখ মুজিবর রহমানের চুক্তি অনুযায়ী তাঁরা সরকারি খাতায় নাগরিক নন। আবেদন করলে কারও নাগরিকত্ব যাবে না বলেও আশ্বস্ত করা হচ্ছে বিজেপির তরফে।
মতুয়াদের নাগরিকত্ব নিয়ে তৃণমূল-বিজেপির চাপানউতোরে শেষ পর্যন্ত মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক কোন দিকে ঝোঁকে, তার উপরে নির্ভর করবে বাগদা বিধানসভার ভোটের ফল।
এক সময়ে বাগদা ছিল তৃণমূলের খাসতালুক। বাম আমলে ২০০৬ সালে গোটা রাজ্যে তৃণমূলের ভরাডুবির মধ্যেও বাগদা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের টিকিটে জয়ী হয়েছিলেন দুলাল বর।
তার আগে ২০০৩ সালে বাগদা পঞ্চায়েত সমিতি দখল করেছিল তৃণমূল। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে জয়ী হন প্রাক্তন সিবিআই কর্তা উপেন বিশ্বাস।
তৃণমূল ‘ব্যাক ফুটে’ যেতে শুরু করে ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোট থেকে। সে বার তৃণমূলের প্রাক্তন বিধায়ক দুলাল বর কংগ্রেসের টিকিটে ভোটে দাঁড়ান। বামেরা কংগ্রেস প্রার্থী দুলালকে সমর্থন করে। ফের ভোটে জিতে যান দুলাল।
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বাগদা থেকে বিজেপি প্রার্থী শান্তনু ঠাকুর ২৪ হাজার ৪৫৭ ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন। ২০২১ সালে বাগদা বিধানসভায় বিজেপি প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাস ৯৭৯২ ভোটে জয়ী হন। বিশ্বজিৎ পরে তৃণমূলে যোগদান করেন। তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব বিশ্বজিৎকে দলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি পদে বসান। তাঁকেই লোকসভা ভোটে প্রার্থী করেছে তৃণমূল।
সাম্প্রতিক অতীতে পর পর ভোটে ভরাডুবির কারণ হিসেবে উঠে আসছে তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দলের কথা। তা ছাড়া, নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও কারণ বলে মনে করেন অনেকে। তবে জেলা সভাপতি হওয়ার পর থেকে বিশ্বজিৎ বাগদার সব নেতানেত্রীদের এক ছাতার তলায় আনার চেষ্টা শুরু করেন। এখন প্রকাশ্যে কোন্দল অনেকটা মেটানো গিয়েছে বলে নেতৃত্বের একাংশের দাবি। বিশ্বজিৎ বলেন, “পঞ্চায়েত ভোটের সাফল্য ধরে রেখে এখান থেকে ১৫-২০ হাজারের লিড পাব আমরা। এখন বাগদায় তৃণমূলের মধ্যে কোনও গোষ্ঠীকোন্দল নেই।” প্রসঙ্গত, গত পঞ্চায়েত ভোটে বাগদা ব্লকের ৯টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ৬টি জেতে তৃণমূল। পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদের তিনটি আসনও পায় তারা।
২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকে বিজেপি এখানে শক্তিবৃদ্ধি করতে থাকে। গত পঞ্চায়েত ভোটে বিজেপি তিনটি পঞ্চায়েত দখল করে। তবে বিজেপিকেও এখানে ভোগাতে পারে দলের গোষ্ঠীকোন্দল।
বিজেপির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি দেবদাস মণ্ডল বলেন, “বিধায়ক হিসেবে বিশ্বজিৎ দাস বাগদায় পঞ্চায়েতে ভোট লুট করা, বিজেপির জয়ী প্রার্থীদের শংসাপত্র কেড়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনও কাজ করেননি। বিজেপির টিকিটে দাঁড়িয়ে তৃণমূলে যোগদানের জবাবও বাগদার মানুষ দেবেন। গত লোকসভার তুলনায় বিজেপির ব্যবধান আরও বাড়বে।”
২০১১ সালের পর থেকে বাগদায় কংগ্রেস, সিপিএমের রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এরই মধ্যে অবশ্য ২০১৬ সালে কংগ্রেস প্রার্থী দুলাল বর জয়লাভ করেছিলেন। কিন্তু তারপর থেকে আর সাফল্য নেই। বনগাঁ লোকসভায় এ বার বাম-কংগ্রেসের আসন সমঝোতা হয়েছে। কংগ্রেস প্রার্থী দিয়েছে। কংগ্রেস প্রার্থী প্রদীপ বিশ্বাস ভাল ফল করার বিষয়ে আশাবাদী। তিনি বলেন, “বাগদা কেন্দ্র থেকে আমরা যথেষ্ট ভাল ফল করব। তার প্রথম কারণ, বাম নেতা-কর্মীরা সক্রিয় ভাবে আমার হয়ে প্রচার করছেন। আমাকে আন্তরিক ভাবে সহযোগিতা করছেন। তা ছাড়া, আমি নিজে মতুয়া পরিবারের সন্তান হওয়ায় মতুয়া উদ্বাস্তুদের বড় অংশের ভোট পাব।”