দক্ষিণ কলকাতায় বিজেপি প্রার্থী প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরী। ছবি: এক্স।
এ বার দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জ আসনে তাঁর প্রার্থিপদ নিয়ে বিস্তর টানাপড়েন চলেছে দলের অন্দরে। প্রাথমিক ভাবে নিজেও চাননি আবার রায়গঞ্জ থেকে ভোটে দাঁড়াতে। প্রত্যাশা মতো দক্ষিণবঙ্গের আসন পেলেন বটে। কিন্তু তা আদতে কঠিন ঠাঁই। তৃণমূলের দুর্গ বলে পরিচিত দক্ষিণ কলকাতায় বিজেপি প্রার্থী প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরী।
দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে রবিবার দ্বিতীয় দফায় বাংলার ১৯ জনের প্রার্থিতালিকা ঘোষণা করেছে বিজেপি। সেই তালিকায় দেবশ্রীর নাম রয়েছে। প্রার্থী ঘোষণা হওয়ার পর দেবশ্রী বলেন, ‘‘বিজেপির অনুগত সৈনিক। দল যেখান প্রার্থী করবে, সেখান থেকেই ল়ড়ব।’’
২০১৯ সালের রায়গঞ্জ আসন থেকে জিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছিলেন দেবশ্রী। বিরোধীরা বলেন, মহম্মদ সেলিম এবং দীপা দাশমুন্সির দ্বৈরথ ওই আসনে দেবশ্রীকে বৈতরণী পার করিয়ে দিয়েছিল। ফলে দেবশ্রী যে মন্ত্রী হতে পারেন, তা-ও কেউ আশা করেননি। রাজ্য বিজেপি-র নেতাদের অনেকেই অবাক হয়েছিলেন রায়গঞ্জের সাংসদের নাম কেন্দ্র্রীয় মন্ত্রী হিসেবে ঘোষণার পরে। বঙ্গ রাজনীতির এক আপাদমস্তক রহস্য এবং প্রহেলিকা হিসাবেই মন্ত্রিত্বে উত্থান হয়েছিল দেবশ্রীর। অবনমনও অপ্রত্যাশিত গতিতে। দু’বছরের মধ্যেই মন্ত্রিত্ব থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বিধানসভা নির্বাচনেও তাঁর তেমন ভূমিকা ছিল না। এ বার দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে প্রথম থেকেই তাঁর রায়গঞ্জ আসনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন ছিল। কারণ, বিজেপি সূত্রে খবর, দেবশ্রীই আর রায়গঞ্জ থেকে ভোটে দাঁড়াতে চাইছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন দমদম আসন থেকে লড়তে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে দক্ষিণ কলকাতার প্রার্থী করল পদ্মশিবির।
দলীয় সূত্রে খবর, দেবশ্রী যখন দমদম থেকে দাঁড়ানোর ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন, তত দিনে সেই আসনে শীলভদ্র দত্তের নাম ভাবা হয়ে গিয়েছিল। তা জানানোও হয়েছিল দেবশ্রীকে। এর পর তিনি আবার রায়গঞ্জ আসনে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে কার্তিক পালকে প্রার্থী করার ভাবা হয়ে গিয়েছিল। শনিবার যখন প্রার্থিতালিকা চূড়ান্ত হচ্ছিল, তখনও দক্ষিণ কলকাতায় দেবশ্রীকে টিকিট দেওয়া নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলে দলের অন্দরে। শেষ পর্যন্ত ওই আসনে দেবশ্রীর নামই ঘোষণা করল দল।
বালুরঘাটের মেয়ে দেবশ্রী। পড়াশোনাও সেখানে। খাদিমপুর গার্লস স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক। তার পরে বালুরঘাট কলেজ। ছোট থেকেই সংযোগ সঙ্ঘের সঙ্গে। কলেজ জীবনেই এবিভিপি-তে নজর কাড়েন সাংগঠনিক স্তরে। ফলে যুব মোর্চায় তাঁর উত্তরণও ঘটে দ্রুতই। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে দেবশ্রীকে প্রার্থী করেছিল বিজেপি। রাজনীতিতে তখন আনকোরা বাবুল সুপ্রিয় পাশের আসন আসানসোল থেকে জিতলেও দেবশ্রী বর্ধমান-দুর্গাপুরে সে ভাবে দাগ কাটতে পারেননি। সেই হিসেবে ২০১৯ সালের জয়ই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম সাফল্য। কিন্তু বিজেপি সূত্রের বক্তব্য, রাজ্যে গত বিধানসভা নির্বাচনে দেবশ্রীর রিপোর্ট কার্ড একেবারেই ভাল ছিল না। দেবশ্রীর নিজের এলাকাতেও খারাপ ফল করে বিজেপি। লোকসভায় চারটি আসনে বিজেপি এগিয়ে থাকলেও বিধানসভা ভোটে জয় মেলে দু’টিতে। তখন থেকেই দলের একাংশের আতশকাচের তলায় ছিলেন দেবশ্রী। সেই অংশের বক্তব্য, লড়াকু মনোভাবের দিক দিয়ে খানিকটা পিছিয়ে দেবশ্রী। দীর্ঘদিন রাজনীতিতে থাকলেও নিজস্ব ক্যারিশমা নেই।
যদিও এই দাবি মানতে রাজি নন দলের অন্য একটি অংশ। তাঁদের বক্তব্য, রাজ্য রাজনীতিতে দেবশ্রীর নাম প্রথম বার চর্চায় এসেছিল ২০০৬ সালে। বাম জমানার দোর্দণ্ড প্রতাপ মন্ত্রী তথা আরএসপি নেতা বিশ্বনাথ চৌধুরীর বিরুদ্ধে সে বার তৃণমূল সমর্থিত বিজেপি প্রার্থী ছিলেন দেবশ্রী। দাপুটে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে লড়তে নেমেও প্রচারে যে ভাবে দাপট দেখিয়েছিলেন যুবনেত্রী, সে কথা এখনও মুখে মুখে ফেরে। তা ছাড়া দেবশ্রী বিজেপি-র ‘আদি’ শিবিরের সদস্য। উত্তরবঙ্গে হিন্দুত্ব রাজনীতির সূচনালগ্ন থেকেই ছিলেন বালুরঘাটের দেবীদাস চৌধুরী। তাঁরই কন্যা দেবশ্রী। ফলে তাঁর বিজেপি-তে উত্থানের পিছনে আরএসএস-এর ভূমিকা বরাবরই ছিল। গোটা পরিবারই সঙ্ঘের অনুগামী। দলের এক রাজ্য নেতার কথায়, ‘‘দলের দেওয়া যে কোনও দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার মতো মানসিক প্রস্তুতি থেকে কখনও পিছু হঠেননি দেবশ্রী চৌধুরী। তারই পুরস্কার পেলেন তিনি।’’