Lok Sabha Election 2024

ভোট বৈতরণী পারে দু’কূলেই রাম শরণ

দুয়ারে লোকসভা ভোট। প্রতিটি কেন্দ্রের অধীনে সাতটি বিভানসভা। কী বলছে জনতা? রইল বিধানসভাওয়াড়ি পরিক্রমা।

Advertisement

বরুণ দে

মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০২৪ ০৯:০৩
Share:

মেদিনীপুর শহরের কুইকোটায় দেওয়াল প্রচার। —নিজস্ব চিত্র।

কংসাবতীর ঘাটের কাছে নতুন করে রাম-সীতা মন্দির তৈরি হয়েছে। ‘পাশে’ থেকেছে তৃণমূল পরিচালিত পুরসভা। অযোধ্যায় রামমন্দিরের উদ্বোধনের আগে আগে মেদিনীপুরের নবনির্মিত এই মন্দিরের উদ্বোধন হয়েছে। ধুমধাম করে রামনবমী পালন করেছে যুযুধান শিবির। গেরুয়া শিবির বলেছে, ‘জয় শ্রীরাম।’ পাল্টা ঘাসফুল শিবির বলেছে, ‘জয় সীতা-রাম।’

Advertisement

রাম-হাওয়া বিজেপির কাছ থেকে কাড়তে মরিয়া তৃণমূল। তৃণমূল পুরপ্রধান সৌমেন খান বলছিলেন, ‘‘রামকে নিয়ে রাজনীতি কারা করছে? ওরা জয় শ্রীরাম বলছে, আমরা জয় সীতা- রাম বলছি। আমরা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করি না।’’ যা শুনে পাল্টা বিঁধছে বিজেপি। জেলা বিজেপির মুখপাত্র অরূপ দাস বলছিলেন, ‘‘তৃণমূলের নেতাদের লজ্জা করে না? সেদিনের কথা মনে নেই? যেদিন জয় শ্রীরাম বলায় মুখ্যমন্ত্রী গাড়ি থেকে নেমে বলেছিলেন, গালাগালি দিচ্ছেন কেন!’’

মেদিনীপুর বহু আন্দোলনের ধাত্রীভূমি। এখানে ভোটের প্রচারে এ বার স্থানীয় সমস্যার কথা সে ভাবে কেউই বলছে না। শহরে একটি উড়ালপুল রয়েছে। রাঙামাটিতে। বাম আমলে হয়েছে সেটি। তাঁতিগেড়িয়ায় উড়ালপুল কিংবা আন্ডারপাসের প্রয়োজন। কবে হবে, সেই প্রশ্নও নেই! প্রচার জুড়ে রয়েছে লক্ষ্মীর ভান্ডার, সন্দেশখালি, চুরি-দুর্নীতি ইত্যাদি। ঘাসফুল শিবিরের নালিশ, গেরুয়া শিবির মেরুকরণের রাজনীতি করছে। গেরুয়া শিবিরের পাল্টা নালিশ, ঘাসফুল শিবির তুষ্টিকরণের রাজনীতি করছে। রাজ্যে পালাবদলের পরে তৃণমূলের খাসতালুক হয়ে উঠেছিল মেদিনীপুর। গত লোকসভা ভোটে ধাক্কা খায় তারা। উনিশের ভোটে এই বিধানসভায় তৃণমূলের থেকে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার ভোট বেশি পেয়েছিল বিজেপি। একুশের বিধানসভায় গড় পুনরুদ্ধার করেছে তৃণমূল। বিজেপির থেকে তারা এগিয়ে প্রায় ২৪ হাজার ভোটে।

Advertisement

৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত এবং ১টি পুরসভা এলাকা নিয়ে এই বিধানসভা কেন্দ্রের বিন্যাস। ৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৪টি মেদিনীপুর (সদর) ব্লকের, ৫টি শালবনি ব্লকের। অনেকে মনে করছেন, জয় এবং মার্জিনের নির্ণায়ক হতে পারে বাম ভোট। ২০১৬-এর বিধানসভায় বামেরা পেয়েছিল প্রায় ৭৪ হাজার ভোট। বিজেপি পেয়েছিল প্রায় ২৩ হাজার ভোট। ২০১৯ এর লোকসভায় এখানে বিজেপি পেয়েছে প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার ভোট। বামেরা পায় মাত্র প্রায় ১০ হাজার ভোট। বাম ভোট বামে ফিরলে লাভ তৃণমূলেরই। মেদিনীপুরের বাম প্রার্থী বিপ্লব ভট্ট অবশ্য জানাচ্ছেন, তাঁদের লড়াই বিজেপি এবং তৃণমূল-দু’দলের বিরুদ্ধেই। তিনি বলছেন, ‘‘যাঁরা ভুল বুঝে দূরে সরে গিয়েছিলেন, তাঁরা ফিরে আসছেন।’’ তৃণমূল প্রার্থী জুন মালিয়া অভিনেত্রী। বিজেপি প্রার্থী অগ্নিমিত্রা পাল ফ্যাশন ডিজাইনার। বাম প্রার্থী বিপ্লব বলছেন, ‘‘আমি রাজনীতির ময়দানে নেমেছি। অভিনয় করতে তো নামিনি। অভিনয় করতে গেলে ওঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ব্যাপার থাকে! মানুষের দাবিদাওয়া সংসদে উচ্চারিত করার কথা বলছি। সাড়াও পাচ্ছি।’’

তৃণমূল ও বিজেপি দু’দলের প্রার্থীই প্রচারে পেশাগত পরিচয় দূরে রাখছেন। জুন বলছেন, ‘‘আমি তো মেদিনীপুরেরই মেয়ে। আপনাদের ঘরের মেয়ে।’’ অগ্নিমিত্রাও বলছেন, ‘‘আমি কিন্তু নেত্রী নই। আমি আপনাদের বাড়ির মেয়েই।’’ জুন শোনাচ্ছেন, ‘‘লক্ষ্মীর ভান্ডারের মায়েরা, টাকাটা বেড়েছে তো? কে পাশে দাঁড়িয়েছেন? মমতাদি।’’ অগ্নিমিত্রা আশ্বাস দিচ্ছেন, ‘‘আমরা ক্ষমতায় এলে তিন হাজার টাকা করে পাবেন। অন্নপূর্ণা যোজনার মাধ্যমে।’’ বিজেপি প্রার্থীর দাবি, তাঁর লড়াই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে, তৃণমূলের নীতির বিরুদ্ধে। জুন কেউ নন! জুনেরও বার্তা, প্রার্থী মমতাই!

যুযুধান শিবিরকেই চিন্তায় রেখেছে দলের দ্বন্দ্ব। মেদিনীপুরের সাংসদ ছিলেন বিজেপির দিলীপ ঘোষ। এখানে দিলীপের অনুগামীর সংখ্যা কম নয়। একাংশ অনুগামী প্রচারে তেমন সক্রিয় নন। গেরুয়া শিবিরের অবশ্য দাবি, গোড়ায় কারও কারও মন খারাপ হয়েছিল! পরে তাঁরা প্রচারে নেমে পড়েছেন। বিজেপি প্রার্থীকেও বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘দিলীপদার (দিলীপ ঘোষের) আশীর্বাদ নিয়ে আমি তাঁর কেন্দ্রে লড়তে এসেছি। দিলীপদা আমার প্রচারে আসবেন। কথা দিয়েছেন।’’ মেদিনীপুরে তৃণমূলের দ্বন্দ্বও নতুন নয়। একদিকে সৌমেন খান, আরেকদিকে বিশ্বনাথ পাণ্ডবদের অনুগামীরা। সৌমেনরা জুনের অনুগামী। বিশ্বনাথরা দলের জেলা সভাপতি সুজয় হাজরার অনুগামী। দ্বন্দ্ব রয়েছে জেনেও বিধায়ক জুনের উপর ‘বাজি’ রেখেছে দল। তৃণমূল নেতৃত্বের অবশ্য দাবি, ভুল বোঝাবুঝি মিটে গিয়েছে। সত্যিই কী তাই? একাংশ পুর-প্রতিনিধিকে ততটা সক্রিয় দেখাচ্ছে না তো? মাঝেমধ্যে প্রচারে দেখা যাচ্ছে, এমন এক তৃণমূল পুর-প্রতিনিধি অবশ্য বলছেন, ‘‘ভালবাসলে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে হবে। এক হাত পিঠে রাখব, অন্য হাতে ছুরি মারব, এ শিক্ষা পাইনি! প্রচারে সব সময়েই আছি!’’

প্রার্থী হয়ে এখানে আসার পরেই অগ্নিমিত্রা তাঁর হোয়াটসঅ্যাপের ডিপি (ডিসপ্লে পিকচার) পরিবর্তন করে নিয়েছিলেন। ডিপি-তে লেখা, ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী।’ ভোটের মুখে জুনের সমর্থনে লাগানো ফেস্টুনে দেখা যাচ্ছে, ‘মেদিনীপুরের মেয়ের গর্জনে, বাংলা বিরোধী যাবে বিসর্জনে।’ অনেকের মনে পড়ে যাচ্ছে একুশের ভোটে ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’ স্লোগান নিয়েই ময়দানে নেমেছিল তৃণমূল। বাজিমাতও করেছিল তারা। কী হবে এ বার?

উত্তরের অপেক্ষায় মেদিনীপুর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement