Goutam Halder

‘কু’ বলে ভাববেন না, এখন সবটাই অলীক সুনাট্য রঙ্গ

রাজনীতি কি ভাল? রাজনীতি কি মন্দ? ভাল-মন্দ তো আপেক্ষিক। এটা সভ্যতার উপাদান। ছিল। আছে। থাকবে।

Advertisement

গৌতম হালদার

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২৪ ২০:০৮
Share:

জীবনের নানা ওঠাপড়া যে ভাবে গায়ে লাগে, তার প্রতিক্রিয়াই রাজনীতি। আমার তো তা-ই মনে হয়। এই যে জ্ঞানীরা বলেন, রাজনীতি জীবনের অঙ্গ, সেটা কিন্তু ঠিকই বলেন। আমি ব্যাখ্যাটাকে আমার মতো করে একটু সাজিয়ে নিয়েছি। এই আর কী! তবে রাজনীতি কি ভাল? রাজনীতি কি মন্দ? ভাল-মন্দ তো আপেক্ষিক। এটা সভ্যতার উপাদান। ছিল। আছে। থাকবে।

Advertisement

স্কুল-কলেজ জীবনে আমি বামঘেঁষাই ছিলাম। তখন ধারণা স্পষ্ট ছিল না। বিষয়টা পরিষ্কার হল থিয়েটার করতে এসে। প্রথম যখন গ্রিক নাটক পড়লাম, ভেতরে ভেতরে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল— ওহ্ আচ্ছা! এমনটাও হয়! তখন থেকেই নিজের ব্যাখ্যা তৈরি করার চেষ্টা করতে করতে একটা সময়ে এসে বুঝেছি, ওটা আসলে রাজনীতিই। এ সব তো জীবনের প্রথম যুগের কথা। এর প্রায় তিরিশ বছর পর যখন শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ করলাম, তখন আরও গভীর ভাবে বুঝলাম রাজনীতির মানে। বুঝলাম, একটা থিয়েটারে রাজনীতি জড়িয়ে থাকে। বুঝতে পারলাম, পরিবারে কোথায় রাজনীতি রয়েছে। সমাজের কোন স্তরে কোন রাজনীতি খেলা করে সেটাও জানতে পারলাম আস্তে আস্তে। এমনকি, থিয়েটারের অভ্যন্তরের রাজনীতির ‘পাল্‌স’টাও ধরতে পারলাম যেন!

কয়েক দশক ধরে নাটক করছি। নাটক সম্পর্কের কথা বলে। সেই সম্পর্কের নানা স্তর রয়েছে। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক। ব্যক্তির সঙ্গে পরিবারের সম্পর্ক। ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক। ব্যক্তির সঙ্গে দেশের সম্পর্ক। আবার এই সকল সম্পর্কই পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে। বরং বলা ভাল, লেপ্টে রয়েছে। আরও অনেক সম্পর্ক রয়েছে। যেমন, ছোটদের সঙ্গে বড়দের সম্পর্ক। সমবয়সিদের মধ্যে সম্পর্ক। বন্ধুত্বের সম্পর্ক। এ সবের কথাই তো আমরা থিয়েটারে বলি। বড় নাটক তো আসলে বড় সাহিত্যও। আর সাহিত্য শব্দটা এসেছে ‘সহিত’ অর্থাৎ ‘সঙ্গে’ থেকে। কাজেই কে কার সঙ্গে আছে, কোথায় আছে, কী অবস্থানে আছে— এটা বোঝাটাই একটা কাজ। জীবনের কাজ। আর থিয়েটার জীবন দেখতে শেখায়। জানতে শেখায়। সেখানেও রয়েছে রাজনীতি।

Advertisement

অদ্ভুত হলেও সত্যি যে, সেই জানার কোনও শেষ নেই। যতই আমরা আমাদের জীবনকে বোঝার, জানার চেষ্টা করি না কেন, তা কিন্তু অজানাই থেকে যায় শেষ পর্যন্ত। আমরা থিয়েটারের লোকজন আরও একটু গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করি। অনন্ত গভীরে। দেখেছি, সেখানে কিছু একটা খেলা করে। অন্ধকার, তবুও সেই খেলা টের পাওয়া যায়। সেখানে রয়েছে প্রকৃতির টানাপড়েন। জৈবিক টানাপড়েন। এবং অবশ্যই রাজনৈতিক টানাপড়েন। এগুলো আমাদের অবচেতনেও এমন ভাবে কাজ করে, যার খানিক বোঝা যায়। খানিক যায় না। এটা বুঝতে চাওয়াটাই থিয়েটারের কাজ। এককথায় বলতে পারি, এটাই জীবনের পথে চলা। জীবনের স্বাদ পেতে পেতে চলা। জীবনকে আস্বাদন করি আমরা সকলেই। কিন্তু থিয়েটারের মানুষ, এই আমরা, আরও একটু অন্ধকারে যাই। তাতে আরও হাতড়াই।

মনস্তাত্ত্বিক সিগমুন্ড ফ্রয়েড শিল্পীদের সম্পর্কে একটা কথা বলেছিলেন। সেটা আমার খুব অদ্ভুত লাগে এখনও। বিশেষ করে মঞ্চাভিনেতা হিসাবে। ধরা যাক আমি একটা চরিত্রে অভিনয় করছি। আমি তো সংলাপ, শরীরী ভাষা, অভিনয়— সবটা দিয়ে ওই চরিত্রের মাধ্যমে দর্শকের কাছাকাছি যেতে চাই। দর্শকের মনে ঢুকে পড়তে চাই। তার মনন দখল করতে চাই। উল্টো দিকে, অভিনয় দেখে দর্শকদের ভাল লাগছে। নিজেদের সঙ্গে তাঁরা মেলাতে পারছেন। অভিনেতার তারিফ করছেন। আর মঞ্চের শিল্পী তখন ভাবছেন, তিনি দর্শকের কাছে পৌঁছে গেলেন। মনে ঢুকে পড়লেন। মনন দখল করলেন। দর্শকের আরও কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন। যা তিনি চাইছিলেন। ফ্রয়েড বললেন এর একটা উল্টো খেলার কথা। তিনি বললেন, ওই সব হওয়ায় অভিনেতা আরও দূরে চলে গেলেন। সাধারণ মানুষই তাঁকে দূরে ঠেলে দিলেন। পরে ভেবে দেখেছি, এটা অত্যন্ত সত্যি। এই যে আমরা পর্দায় বা মঞ্চে যে নায়ক-নায়িকাদের দেখি, ওই সময়টায় হয়তো ওদের ঘরের ছেলেমেয়ে মনে হয়। কিন্তু আদতে তো দূরেরই ভাবি। তাই না? বহু দূরের মানুষ। আর তখন অভিনেতা হিসেবে আমার মনে হয়, আমি তো কাছে যেতে চেয়েছিলাম। তা হলে আমাকে কেন দূরে ঠেলছে? রাজনীতি।

আরও একটু খোলসা করি। ধরুন, আমি মঞ্চে রাজার চরিত্রে অভিনয় করছি। ওই চরিত্রের মধ্যে দিয়ে গহিন অন্ধকারে ঢোকার চেষ্টা করি। দর্শকের মনের গভীরে কী আছে, চেষ্টা করি সেটা ছোঁয়ার। কাছের মানুষের মন ছোঁয়ার চেষ্টাই তো আমরা সারা জীবন ধরে করি। বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তান, প্রেমিকা, প্রিয় বন্ধু— ব্যক্তিজীবনেও তো আমি তাঁদের মনের ভিতরেই যেতে চাই। জীবনে এমনটাই হয়। আমরা মঞ্চেও সেই চেষ্টা করি। কিন্তু দেখি, দূরে চলে গিয়েছে। এ বার আমি ধরুন, প্রজার চরিত্র করলাম। রাজা হয়ে বুঝেছি। প্রজা হয়েও নিজের বোঝাটা দর্শকের মধ্যে চারিয়ে দিলাম। কিন্তু সত্যিই কি কাছের মানুষ হয়ে উঠলেন ওঁরা? আমি কি পারলাম? নাহ‌্, পারলাম না।

আমার মনে হয়, অভিনেতার মতো এক জন নেতাও ঠিক একই রকম ভাবেই সাধারণের কাছ থেকে দূরে চলে যান।

আসলে প্রজা ভাবে, রাজার অনেক ক্ষমতা। তিনি ক্ষমতার বলয়ের ভিতরেই থাকেন। রাজার যা না ক্ষমতা, প্রজার কাছে তা-ই ১০০ গুণ বেশি করে ধরা পড়ে। আমার নায়ক (এ ক্ষেত্রে রাজা) এতটাই ক্ষমতাবান যে, আমি তাঁকে ভয় পেতে শুরু করি। ক্ষমতাকে লোকে সহজে ভালবাসতে পারে না। এ বার কেউ বলতেই পারেন, বিদ্যাসাগর বা বিবেকানন্দও প্রভূত ক্ষমতাবান ছিলেন। সামাজিক ভাবে। ব্যক্তি হিসেবেও। তাঁদের তো কেউ ভয় পেতেন না! পেতেন। তাঁদেরও মানুষ ভয় পেতেন। তবে সে ভয় থাকত সম্ভ্রমে মোড়া। একই সঙ্গে এটাও তো বুঝতে হবে যে, রাজনীতির লোকেদের ক্ষমতা আর ওঁদের ক্ষমতা, দুটোর দু’রকম রূপ।

সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা দোলাচল আছে। সে ভাবে, কার কাছে সে বেশি নিরাপদ। এটার নিশ্চিত উত্তর সে পায় না। হয়তো সে ভাবার চেষ্টা করে, ‘শ্যাম’ মানুষটি খুব ভাল রাজনীতিক। মানুষ হিসেবেও অতুলনীয়। শ্যামের কাছেই সে থাকতে চায়। কিন্তু একই সঙ্গে সে ভেবে নেয়, শ্যামকে দিয়ে তার কোনও কাজ হবে না। তার কাছ থেকে কোনও সুবিধে পাওয়া যাবে না। তাই সে এমন এক জনের কাছে চলে যায়, যে অন্য অর্থে শ্যামের থেকে বেশি ক্ষমতাবান। হয়তো সেই ক্ষমতাবান ‘যদু’ তাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিল। খুব সহজেই সে একটা টাকার ব্যবস্থা করে ফেলতে পারল যদুর দৌলতে। এ বার সে-ই যদুর লোক হিসেবে বিবেচিত হল। কিন্তু সে ভাল কিন্তু বাসে শ্যামকেই। আমি এ সব দেখে খুব আহ্লাদিত হই। চিৎকার করে বলে উঠি, আহা এই তো রাজনীতির মাহাত্ম্য! হোক হোক, আরও হোক!

রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ সেই কবে লেখা হয়েছিল। প্রায় ১০০ বছর আগে। কিন্তু এখনও আমি চার দিকে ফাগুলালদের দেখতে পাই। শ্যাম বা যদু, সকলের কাছেই তো আমরা ‘ফাগুলাল’। যেখানে আমি বা সাধারণ মানুষ একটা সংখ্যামাত্র। এটা সভ্যতার চিরন্তন খেলা। খেলা বলবেন, না কি ‘খেলা হবে’ বলবেন, সে আপনার ব্যাপার। আসলে এটা ‘পাওয়ার গেম’। আমি এ ভাবেই দেখি। থিয়েটার করতে গিয়ে এগুলো বোঝার চেষ্টা করি। ভুল হয়। আবার গুছিয়ে নিই। ঠিক যে ভাবে একজন রাজনীতিক নেন। অন্য অর্থেও তিনি গুছিয়ে নেন হয়তো। আবার কেউ কেউ সর্বস্ব ত্যাগ করেন।

আসলে আমার মনে হয়, প্রথমেই ঠিক করে নেওয়া উচিত, আমি কতটা পারব আর কতটা পারব না। মহাপুরুষেরা অনেকটা পারেন। তাঁরা জীবনের সর্বস্ব দিয়ে দেন। আমরা তাঁদের দেখে অনুপ্রাণিত হই বটে। কিন্তু সবটা করতে পারি না। ওঁদের মতো করতে পারলে সমাজটা অন্য রকম হত। সেটা তো হবে না। আমাদের দোষেই হয় না। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ীই হয় না। আমরা ভয় পাই। আবার ‘রক্তকরবী’ মনে পড়ছে। যেখানে নন্দিনী বলছে, ‘‘এখানকার মানুষগুলো কেমন রেগে আছে। অথবা সন্দেহ করছে। অথবা ভয় পাচ্ছে।’’ কী অদ্ভুত কথা! ১০০ বছর আগে লেখা। আবার গ্রিক নাটকে ৩০০০ বছর আগেও একই কথা বলা হয়েছে। গুণগত ভাবে একই কথা। এত্ত বছরে পৃথিবীতে অনেক মানুষ বেড়ে গিয়েছে। শুধু আমাদের প্রবণতাগুলো একই থেকে গিয়েছে। এটা সভ্যতার অভিশাপ কি না ঠিক বুঝতে পারি না।

আনন্দবাজার অনলাইনে এত কথা পড়ার পর যে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, ও হে, তোমার থিয়েটারে পলিটিক্স হয়? আমার জবাব হবে, হয়। বাড়িতে রাজনীতি হচ্ছে, পরিবারে রাজনীতি হচ্ছে, সমাজে হচ্ছে, দেশে হচ্ছে। আর থিয়েটারে হবে না? থিয়েটার তো সমাজের দর্পণ। সেখানেও হয়। সেখানেও লোকে ক্ষমতাকে ভয় পায়। কেউ কেউ আবার ভয় পায়ও না। নানা রকম হয়। থিয়েটারেও লোকে রেগে যায়। সন্দেহ করে। অথবা ভয় পায়। কিন্তু আমাদের কাজ হচ্ছে সেগুলোর উপরে উঠে দেখা। এই সবের ভিতরে থেকেই সভ্যতার মঙ্গল বা নিজের মঙ্গলের জন্য কিছু করা যায় কি না সেটা দেখা। বেঁচে থাকার তা হলে একটু মানে পাওয়া যায়। ক্ষমতা সব সময়েই মানুষকে ‘নষ্ট’ করতে চেষ্টা করে। ধরা যাক, আমার সামাজিক ভাবে একটু প্রতিপত্তি হয়েছে। ব্যস, ওটাকেই আমি ক্ষমতা বলে ভাবতে শুরু করলাম। আর তখন থেকেই অন্যেরা আমাকে ভয় পেতে শুরু করল। আর যদি আমাকে ভয় না পায়, তা হলে তো মনে হবেই, যে আমার কোনও ক্ষমতা নেই!

জীবনের এই সব ওঠাপড়াই তো রাজনীতি। গায়ে না লাগালে চলবে? কী বলছেন? এ সব থাকবে না? কী যে বলেন! রাজনীতি ছিল। থাকবে। থাকুক। জরুরি। আবশ্যিকও। রাজনীতি কেমন ভাবে থাকবে, তার বড় উদাহরণ তো রবীন্দ্রনাথই দিয়ে গিয়েছেন, ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে।’

এ কি অলীক কল্পনা? জানি না। তবে এমন স্বপ্ন দেখতে খুউব ইচ্ছে করে। ‘কু’ বলে ভাববেন না, বরং সবটাই অলীক সুনাট্য রঙ্গ। তাতেই লোক মজে আছে। রাঢ়ে। বঙ্গেও।

(লেখক নাট্যকর্মী ও অভিনেতা। মতামত নিজস্ব)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement