পরকলা প্রভাকর। —ফাইল চিত্র।
মে মাসের ৩ তারিখ। এই দিনের তাৎপর্য ঠিক কোথায়?
আলোচনার শুরুতে দর্শকদের উদ্দেশেই প্রশ্নের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন বক্তা। কিন্তু প্রেক্ষাগৃহ নিশ্চুপ!
এক বছর আগে এই দিনে মণিপুরে হিংসা শুরু হয়েছিল। ‘ডাবল এঞ্জিন’-এর রাজ্যে অশান্তি বন্ধ হয়নি এখনও। মৃত্যুর দুশো পার করেছে। ৭০ হাজার মানুষ এখনও ঘরছাড়া— মনে করিয়ে দিলেন পরকলা প্রভাকর নিজেই। মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অনর্গল যে প্রবীণ রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদের পেশাগত ও ব্যক্তিগত পরিচয় ইতিমধ্যেই গোটা দেশ জানে। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা যা যা বলি সেগুলি যে মানুষের অজানা, এমন কিন্তু নয়। কিন্তু কিছু দিন পরে হইচই থিতিয়ে গেলে আর মনে থাকে না।’’ তাঁর বক্তব্য, অল্প দিনের মধ্যে ভুলে যাওয়ার এই প্রবণতা শাসকের সুবিধা করে দেয়। সে কারণে এই স্মৃতিগুলিকে বুনে দেওয়া দরকার। শুক্রবার কলকাতায় অধ্যাপক সংগঠন আয়োজিত এক আলোচনাচক্রে বক্তৃতা দেন প্রভাকর।
গুরুত্বপূর্ণ লোকসভা নির্বাচনের দু’দফার ভোটদান শেষ হয়ে গিয়েছে। বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার বোঝানোর চেষ্টা করছে, গোটা বিশ্বে ভারত এখন বন্দিত। তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়া সময়ের অপেক্ষা। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বভাবতই আপত্তি রয়েছে প্রভাকরের। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, এ এমন এক সময় যখন কাজের খোঁজে পথে নামা ১০০ জন যুবকের মধ্যে ২৪ জন রোজগারহীন। ২০-২৫ বছর বয়সিদের ক্ষেত্রে তা ৪০%। এই মাপকাঠিতে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের অবস্থান ইয়েমেন, ইরান কিংবা আর্মেনিয়ার পাশে। আবার এই দেশেরই ৪০% সম্পদ রয়েছে বিত্তের চূড়ায় থাকা ১ শতাংশের হাতে। দেশ অর্থনীতির বহরে এগিয়ে গেলেও এই সমস্যা মিটবে কি? প্রভাকর সন্দিহান। তাঁর ব্যাখ্যা, ৮১ কোটি মানুষকে টানা পাঁচ বছর নিখরচায় খাদ্যশস্য দেওয়ার কথা ঘোষণা করে দিয়েছে কেন্দ্র। এর সম্ভাব্য অর্থ, আগামী দিনে কতটা কর্মসংস্থান তৈরি করা সম্ভব হবে সে ব্যাপারে সরকারই নিশ্চিত নয়।
অর্থনীতিবিদের আক্ষেপ, হাতে যখন কাজ নেই, আর ভাতের জন্য নির্ভর করতে হয় সরকারের অনুকম্পার উপরে, তখন দেশের সমস্যা নিয়ে আলোচনার সুযোগও সংকীর্ণ হয়ে আসছে। খাস সংসদে! তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন, গুরুত্বপূর্ণ তিন কৃষি আইন পাশ করানোর আগে তিন মিনিটও আলোচনার প্রয়োজন মনে করেনি কেন্দ্র। এত বড় আন্দোলন, এত মানুষের মৃত্যুর পরে সেই সংসদের মাধ্যমেই যখন আইনগুলি ফিরিয়ে নেওয়া হল তখনও কোনও আলোচনা হল না। তাঁর বিস্ময়, ‘‘মেক ইন ইন্ডিয়া, ডিজিটাল ইন্ডিয়া, খেলো ইন্ডিয়ার পরে এ বার কি তবে শাটআপ ইন্ডিয়া!’’
এ বারের ভোট খুব ভেবেচিন্তে না দিলে ভবিষ্যতে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে আর এখনকার রূপে দেখা যাবে কি না, তা নিয়ে আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রভাকর। তা বলতে ভোলেননি এ দিনও। কিন্তু এ বার দর্শকদের থেকে কড়া প্রশ্ন, ‘‘কেন্দ্রে মজবুত সরকার গঠিত না হলে বিনিয়োগ আসবে কি? অর্থনীতির ভিত শক্ত হবে কী ভাবে?’’ প্রভাকর অবশ্য মনে করেন না কেন্দ্রে স্থায়ী সরকার থাকা সত্ত্বেও আর্থিক মাপকাঠিগুলি সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে। কর্পোরেট কর কমলেও বিনিয়োগকারীরা হাত খোলেননি। জিডিপির নিরিখে সঞ্চয় তলানিতে। কমেছে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি।
২০১৪ সালে যখন পরিবর্তনের সরকার দিল্লির মসনদে বসছে, তখন প্রধানমন্ত্রীর মুখে ‘টিম ইন্ডিয়া’। এক দশক পার করে সেটাই বদলে যাচ্ছে মঙ্গলসূত্র, ওবিসিতে। অথচ সমস্ত জনমত সমীক্ষার ফল তো পক্ষে! প্রভাকরের বক্তব্য, ‘‘আমি নিশ্চিত নই। তবে বাইরে আত্মবিশ্বাসের অভিনয় থাকলেও ভিতরে নিশ্চয়ই একটা উদ্বেগ কাজ করছে।’’