অমিত শাহ-হিমন্ত বিশ্বশর্মা। —ফাইল চিত্র।
জ্যৈষ্ঠের দাবদাহের মধ্যেই বেজে উঠল ‘আশ্বিনের আলোকমঞ্জীর’। বঙ্গের ভোটপুজোর সঙ্গে জুড়ে গেল দুর্গাপুজো। যা নিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে তোপ দাগতে শুরু করল তৃণমূল এবং বিজেপি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং বিজেপি শাসিত অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার ভোটপ্রচারে দুর্গাপুজো নিয়ে বক্তব্যকে ‘স্ববিরোধী’ এবং পদ্মশিবিরের অন্দরে ‘দ্বিচারিতা’ বলে আক্রমণ শানাল তৃণমূল। পাল্টা যুক্তি দিয়ে তৃণমূলকে ‘মাদার অফ নিও কমিউনিজ়ম’ বলে কটাক্ষ করল বিজেপি।
সম্প্রতি উলুবেড়িয়ার বিজেপি প্রার্থী অরুণ উদয় পালের সমর্থনে আমতায় জনসভা করতে এসেছিলেন শাহ। সেই সভা থেকেই শাহ বলেছিলেন, ‘‘বাংলায় ইমামদের ভাতা দেওয়া হলেও মন্দিরের পুরোহিতদের ভাতা দেয় না মমতাদিদির সরকার। দুর্গাপুজোয় মমতাদিদি ছুটি দেন না। কিন্তু রমজানে ছুটি দেন!’’ আবার হিমন্ত বাংলার একটি জনসভা থেকে বলেছেন, ‘‘মমতাদিদি, দুর্গাপুজো আসলে পুজোই। তাঁকে আপনি উৎসব বানিয়েছেন।’’
দুই বিজেপি নেতার দুই বক্তব্যকে ‘হাতিয়ার’ করেছে তৃণমূল। দলের এক শীর্ষনেতার কথায়, ‘‘অসত্য বলতে গেলেও সেটা এক সুরে বলতে হয়! বিজেপি ধর্মীয় মেরুকরণ করতে এতটাই মরিয়া যে, অমিত শাহ এবং হিমন্ত বিশ্বশর্মার বক্তব্যে যে কোনও তালমিল নেই, সেটাও খেয়াল রাখতে পারছে না!’’
রাজ্যসভায় বিজেপির সাংসদ তথা বঙ্গ বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য অবশ্য জানিয়েছেন, ‘তাড়াহুড়ো করে’ বলতে গিয়ে আমিত শাহ স্বরস্বতী পুজোর বদলে দুর্গাপুজো বলে ফেলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘তাড়াহুড়োর কারণে অমিত শাহের একটি শব্দ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। উনি সরস্বতী পুজোর কথা বলতে চেয়েছিলেন। এ কথা তো ঠিক যে উলুবেড়িয়া, বাগনান, ধূলাগড়ের মতো রাজ্যের বিস্তীর্ণ জায়গায় বহু স্কুলে সরস্বতী পুজো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বলা হচ্ছে সরস্বতী পুজো হলে নবিদিবসও স্কুলে স্কুলে উদ্যাপন করতে হবে।’’ তবে হিমন্তের বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়েছেন শমীক। তাঁর কথায়, ‘‘সিপিএম একটা সময়ে দুর্গাপুজোকে শারদোৎসব বলে চালাত। তৃণমূল এখন ‘মাদার অফ নিও কমিউনিজ়ম’। এক জন অসমের মানুষ এসে সঠিক কথাই বলেছেন। কারণ পুজোটা পুজোই। উৎসব নয়। প্যান্ডেলে কলাবউয়ের স্নান না হলে, সন্ধিপুজো না হলে তার যথার্থতা নেই। বাঙালি হিসেবে আমি হিমন্তকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’’
রাজ্যের মন্ত্রী তথা মহিলা তৃণমূলের সভানেত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘অমিত শাহ কাঁচা মিথ্যে কথা বলেছেন। আর হিমন্ত বিশ্বশর্মা অমিত শাহের উল্টো সুর গাইতে গিয়ে বাংলার মহিলাদের অপমান করেছেন। বাংলায় নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো করেই মানুষ দুর্গাপুজোকে উৎসবের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে পালন করেন। যাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে দুর্গাপুজোকে আবহমান ঐতিহ্যের সিলমোহর দিয়েছে ইউনেস্কো।’’ চন্দ্রিমা আরও বলেন, ‘‘অমিত শাহ মিথ্যা বলেছিলেন। আর হিমন্ত মহিলাদের অপমান করেছেন। কারণ, রাজ্যের মহিলারাই দুর্গাপুজোর ঔপচারিক কাজের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে। এর থেকেই বোঝা যায় বাংলার সঙ্গে ওঁদের কোনও যোগ নেই। আমরা এই কারণেই বিজেপিকে বলি বাংলা-বিরোধী। কোনও প্রাদেশিকতার নিরিখে নয়।’’
সিপিএম নেতা তথা এ বারের লোকসভা ভোটে দমদমের প্রার্থী সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য অবশ্য ভিন্ন। তাঁর কথায়, ‘‘বিজেপি এবং তৃণমূল দুটো দলই ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে জুড়ে দিয়ে মেরুকরণ জিইয়ে রাখতে চাইছে। বাম জমানায় কখনও এই জিনিস বাংলায় হয়নি। কারণ সরকার এবং ধর্ম মিশে যায়নি। তা করার প্রয়োজনও ছিল না।’’
গত কয়েক বছর ধরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্লোগান—‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। গত দুর্গাপুজোর পর মমতা বলেছিলেন, দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে রাজ্যে ৮০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে। অর্থাৎ, দুর্গাপুজোয় সামগ্রিক ভাবে অর্থনীতিও গতিশীল হয়। রেড রোডের বিসর্জন কার্নিভাল থেকে শুরু করে তাকে জেলায় জেলায় ছড়িয়ে দেওয়াও মমতারই মস্তিষ্কপ্রসূত। তবে রাজনৈতিক মহলের অনেকের মতে, গত পাঁচ বছরে বিজেপির রাজনীতিকে ‘প্রতিরোধ’ করতে মমতাও কৌশলে বদল এনেছেন। কয়েক বছর আগেও মমতার মুখে শোনা যেত, ‘‘আমরা দুর্গাপুজো করি। রাম অকালবোধন করে যাঁর পুজো করেছিলেন, তিনিই আমাদের দেবতা।’’ রাজনৈতিক মহলের অনেকের মতে, মূলত ‘রামনবমী’ এবং ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানকে রাজনৈতিক ভাবে ভোঁতা করার লক্ষ্যেই তৃণমূলনেত্রী সে কথা বলতেন। কিন্তু তৃণমূল সরকারই এ বার প্রথম রামনবমীতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছে। তৃণমূলের অনেক নেতা ঘরোয়া আলোচনায় মানছেন, ‘পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা’র কারণেই সরকারকে তা করতে হয়েছে। আবার বিজেপি নেতারাও ঘরোয়া আলোচনায় মানছেন, দুর্গাপুজোয় রাজ্য সরকার ছুটি দেয় না— শাহের এই বক্তব্য তাঁদের জন্য ‘বিড়ম্বনার কারণ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।