(বাঁ দিকে) শাহজাহান শেখ। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক (ডান দিকে)। —গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।
বাংলার রাজনীতিতে সেই বাম আমল থেকে একটি শব্দবন্ধ চালু রয়েছে— ‘ভোট করানো’। এ ব্যাপারে জেলায় জেলায় সিপিএমের এক এক জন ‘ওস্তাদ’ ছিলেন। তৃণমূল জমানাতেও সেই ‘ঐতিহ্য’ অমলিন থেকেছে। ফলে আসন্ন লোকসভা ভোটের আগে উত্তর ২৪ পরগনায় ভোট করানোর দুই ‘ওস্তাদ’ গরাদের ভিতরে চলে যাওয়ার পরে তৃণমূলের মধ্যেই আলোচনা এবং জল্পনা শুরু হয়েছে। যার মর্মার্থ, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এবং সন্দেশখালির শেখ শাহজাহান না-থাকায় ভোটে কী হবে!
দক্ষিণ ২৪ পরগনা নিয়ে অবশ্য তৃণমূল অনেকটাই নিশ্চিন্ত। উত্তর কখনও-সখনও টলমলে হলেও দক্ষিণ ২৪ পরগনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘোর দুর্দিনেও খালি হাতে ফেরায়নি। একদা তৃণমূলকে দলের অন্দরেই অনেকে রসিকতা করে ‘দক্ষিণ কলকাতার পার্টি’ বলতেন। কারণ, দলের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লোকসভা কেন্দ্র দক্ষিণ কলকাতা। তাঁর হাত ধরেই দলের উত্থান। দক্ষিণ কলকাতা এবং তার লাগোয়া এলাকাতেই সবচেয়ে আগে ফুটেছিল ঘাসফুল। যেমন ফুটেছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনাতেও। দক্ষিণ ২৪ পরগনাই তৃণমূলের উত্থানের ইঙ্গিত দিয়েছিল ২০০৮ সালে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদ জিতেছিল জোড়াফুল শিবির। সে বার পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদও পেয়েছিল তৃণমূল। তবে পূর্ব মেদিনীপুর জেতার নেপথ্যে ছিল ‘নন্দীগ্রাম’। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় কোনও ‘নন্দীগ্রাম’ ছিল না। এখনও দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবার আসন থেকে সাংসদ তৃণমূলের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে দুই ২৪ পরগনার ন’টি লোকসভা আসনের মধ্যে আটটিতেই জিতেছিলেন তৃণমূল প্রার্থীরা। একটিতে তৃণমূল সমর্থিত এসইউসি। ২০১৪ সালের ভোটেও সব আসনে জেতে তৃণমূল। কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় জমি অটুট থাকলেও উত্তরে দু’টি আসন হারাতে হয় তৃণমূলকে। বনগাঁ এবং ব্যারাকপুর জিতে নেয় বিজেপি। ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিংহ অবশ্য তৃণমূলে ফিরেছেন। ২০২১ সালে সেই ক্ষতে কিছুটা প্রলেপ পড়েছিল। কিন্তু লোকসভা ভোটের আগে উত্তরে আবার ‘উদ্বেগে’ তৃণমূল।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বড় অংশে যেমন সংখ্যালঘু ভোট রয়েছে, তেমনই রয়েছে মতুয়া ভোটও। পাশাপাশিই, কামারহাটি থেকে কাঁকিনাড়া পর্যন্ত বিপুল অংশে হিন্দিভাষী ভোটও রয়েছে। সেই জেলায় ভোট করানোর লোকের ‘অভাব’ নিয়ে শাসকদলের অনেক নেতা ঘরোয়া আলোচনায় উদ্বেগ গোপন করছেন না।
একটা সময়ে জ্যোতিপ্রিয় (বালু) ছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সভাপতি। আর শাহজাহানের কাঁধে ভর করে দু’টি লোকসভা ভোটে বসিরহাটের বৈতরণী পার হয়েছে তৃণমূল। দলের অন্দরে সকলেই জানেন, শাহজাহানের উত্থানের ভিত ছিল দু’টি— এক, অর্থ জোগানো। দুই, সংগঠিত বাহিনী। শাহজাহানের এলাকা সীমাবদ্ধ ছিল একটি লোকসভায়। আর জ্যোতিপ্রিয়ের ব্যাপ্তি ছিল সন্দেশখালি থেকে সল্টলেক পর্যন্ত। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘‘অভিজ্ঞরা ভোটের সময় না থাকলে তা তো সমস্যার বটেই। তার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়তে পারে উত্তর ২৪ পরগনা জেলাতেই।’’ ওই নেতা উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘‘বীরভূমে অনুব্রত মণ্ডল গ্রেফতার হওয়ার পর অনেক দিন কেটে গিয়েছে। এই সময়ে সংগঠনে বিকল্প ‘টিম’ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু উত্তর ২৪ পরগনার ক্ষেত্রে এখনও সেই ঠাসবুনোট বাঁধুনি নেই। লোকসভার আগে তা কতটা করা যাবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।’’
প্রকাশ্যে অবশ্য তৃণমূলের নেতারা উত্তর ২৪ পরগনায় ‘বিড়ম্বনা’র কথা স্বীকার করছেন না। তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র তথা রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘নামের অনুপস্থিতি হয়তো থাকবে। তবে বিকল্প সাংগঠনিক বন্দোবস্ত করে ফেলা গিয়েছে। ভোটে এর কোনও প্রভাব পড়বে না।’’ বস্তুত, তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বও মনে করেন, শাহজাহান বা সন্দেশখালিকাণ্ডের প্রভাব ‘তৃণমূল স্তরে’ পড়বে না। যতটা প্রভাব পড়তে পারত, সেটা শাহজাহানকে গ্রেফতার এবং বহিষ্কার করে সামাল দেওয়া গিয়েছে। তবে ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে সংগঠনকে নতুন করে গড়তে হবে ওই জেলায়।
বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেসের মতো বিরোধী দলগুলির বক্তব্য অবশ্য ভিন্ন। বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে ভোট করানো বিষয়টিই একটি গণতন্ত্রের পরিপন্থী সংস্কৃতি। তবে এ বারের লোকসভা ভোট তৃণমূলকে উচ্ছেদ করার ভোট। কোনও ওস্তাদই কিছু করতে পারবে না।’’ সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘তৃণমূল যাদের বাঘ বানিয়েছিল, মানুষ তাদের তাড়া করছেন। বাংলার এই বাস্তবতার কথা আশা করি ওরাও বুঝতে পারছে।’’ প্রদেশ কংগ্রেসের অন্যতম মুখপাত্র সুমন রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘মানুষের রোষ যখন আছড়ে পড়ে, তখন কেউই তা রুখতে পারে না। তৃণমূলের সামনে এখন সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’’