প্রতীকী চিত্র।
জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা। মাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়ে তাই কিছুটা ভয় এবং অনেকটা চিন্তা খুবই স্বাভাবিক। সঠিক পাঠ ও পরীক্ষাপদ্ধতি অনুসরণ পরীক্ষার্থীদের এই ভয়কে জয় করার সাহস জোগাতে পারে।
প্রশ্নের কাঠামো— মাধ্যমিকের বাংলার প্রশ্নপত্রের কাঠামো এখন ছাত্রছাত্রীদের বেশি নম্বর পাওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অনুকূল। একটা সময় ছিল যখন মাধ্যমিকে বাংলায় বিবরণধর্মী প্রশ্নের আধিক্য ছিল। ফলে বেশি নম্বর পাওয়া যথেষ্ট কঠিন ছিল। কিন্তু পরিবর্তিত পাঠক্রম এবং তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে প্রশ্নের পরিবর্তিত ধরন মাধ্যমিকের বাংলায় নম্বর পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হয়েছে। এখন অঙ্ক এবং বিজ্ঞানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাতেও পরীক্ষার্থীরা নম্বর পায়। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই বিশেষ ভাবে সাহায্য করে বহু বিকল্পভিত্তিক এবং অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নগুলি, যেখানে মোট ৩৬ নম্বর থাকে।
এ ছাড়া, কবিতা এবং গল্প থেকে একটি করে ৩ নম্বরের প্রশ্ন থাকে, সাধারণত সেগুলিতে (১+২)-এই অংশ বিভাজন থাকে। কবিতা ও গল্প থেকে রচনাধর্মী ৫ নম্বরের প্রশ্ন থাকে একটি করে। সেগুলিতে অংশ বিভাজন থাকতে পারে, না-ও পারে। প্রবন্ধ থেকেও একটি ৫ নম্বরের প্রশ্ন থাকে, আর নাটক থেকে থাকে একটি ৪ নম্বরের প্রশ্ন। সহায়ক পাঠ ‘কোনি’ থেকে দু’টি ৫ নম্বরের প্রশ্ন থাকে। বঙ্গানুবাদে থাকে ৪ নম্বর। সাধারণত এখানে চারটি বাক্যের বাংলা অনুবাদ করতে হয়। নির্মিতি অংশে প্রতিবেদন বা সংলাপে থাকে ৫, আর প্রবন্ধ রচনায় থাকে ১০ নম্বর। ৯০ নম্বরের এই লিখিত পরীক্ষা ছাড়া বাকি ১০ নম্বর থাকে প্রকল্পে, যেটি স্কুলের তত্ত্বাবধানে পরীক্ষার্থীরা করে থাকে।
সময় মেপে পরীক্ষা— প্রশ্নপত্রেই নির্দেশ দেওয়া থাকে প্রশ্নের ক্রম অনুযায়ী উত্তর করার জন্য। এতে সুবিধা হল পরীক্ষার্থীরা প্রথমেই এমসিকিউ এবং এসএকিউ-এর উত্তরগুলি করে নেবে, ফলে এখান থেকে যে সময়টা উদ্বৃত্ত হবে, তা পরে অন্য প্রশ্নের উত্তর লেখার সময়ে কাজে লাগাতে পারবে। মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের চলন হল কম নম্বর থেকে বেশি নম্বরের প্রশ্নের দিকে। স্বাভাবিক ভাবেই নির্দিষ্ট ক্রমে উত্তর দিলে উদ্বৃত্ত সময় সম্পর্কে পরীক্ষার্থীদের একটা ধারণা তৈরি হবে, যে সময়টা তারা ব্যয় করতে পারবে রচনাধর্মী প্রশ্ন এবং প্রবন্ধ রচনায়। যদি নির্দিষ্ট ক্রমে উত্তর দেওয়া সম্ভব না-ও হয়, সে ক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীরা একটি প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই এক জায়গায় করবে। তাতে মূল্যায়নের সুবিধা হয়।
যে ভাবে পড়বে— অবশ্যই পড়তে হবে খুঁটিয়ে। যেহেতু এমসিকিউ এবং এসএকিউ-এ অনেক নম্বর থাকে, তাই মূল পাঠ্যবই পড়াই একমাত্র সমাধান। পড়ার সময়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কিংবা উক্তিগুলি চিহ্নিত করে রাখতে হবে। পরীক্ষার আগে সেগুলিতেই বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। ব্যকরণের ক্ষেত্রে বিষয়ের তত্ত্বগত দিক জানার সঙ্গে সঙ্গেই তা যথেষ্ট পরিমাণে অনুশীলন করতে হবে। অবসর সময়ে পাঠ্য গল্প, কবিতা কিংবা প্রবন্ধগুলিকে মনে করার চেষ্টা করতে হবে, বিষয়বস্তুগুলিকে চরিত্র বা ঘটনাক্রম অনুসারে মনের মধ্যে সাজাতে হবে। একই কথা প্রযোজ্য সহায়ক পাঠ ‘কোনি’ উপন্যাসের ক্ষেত্রেও। এই শেষ সময়ে অতিরিক্ত কঠিন প্রশ্নের দিকে না ঝুঁকে মাধ্যমিকের মান অনুসারে প্রশ্ন অনুশীলনে মন দিতে হবে। প্রস্তুতির জন্য কয়েকটা মক টেস্ট দেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ প্রকাশিত টেস্ট পেপারের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। এমসিকিউ, এসএকিউ, বিশেষত ব্যকরণের জন্য বোর্ডের টেস্ট পেপারের অন্তত দশটি প্রশ্নপত্র সমাধান করা উচিত।
বিষয় নির্বাচন— সমগ্র পাঠ্যবই থেকে কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে বেশি নম্বর পাওয়ার লক্ষ্যে। ‘অভিষেক’ বা ‘সিন্ধুতীরে’- এর মতো আখ্যানধর্মী কবিতাগুলি এ ক্ষেত্রে ব্যঞ্জনাধর্মী কবিতাগুলির থেকে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। গল্পের ক্ষেত্রে অবশ্য প্রতিটি গল্পের কাহিনিকে ঘটনা-পারম্পর্য অনুযায়ী মনে রাখতে হবে।
গুরুত্ব যেখানে— গত কয়েক বছরের প্রশ্নপত্র পর্যবেক্ষণের পরে ২০২৫-এর মাধ্যমিকের প্রশ্নপত্র নিয়ে কিছু প্রত্যাশা করা যেতে পারে। যদিও তা সম্পূর্ণই পর্যবেক্ষণ-নির্ভর।
● সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্নের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলিতে গুরুত্ব দিতে হবে:
কবিতা : আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি, অভিষেক, সিন্ধুতীরে, অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান।
গল্প : বহুরূপী, পথের দাবী , নদীর বিদ্রোহ।
● কবিতার ক্ষেত্রে রচনাধর্মী প্রশ্নের জন্য ‘অসুখী একজন’, ‘আফ্রিকা’, ‘অভিষেক’, ‘প্রলয়োল্লাস’ গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। সে রকমই গল্পের ক্ষেত্রে ‘জ্ঞানচক্ষু’, ‘অদল বদল’, ‘নদীর বিদ্রোহ’ রচনাধর্মী প্রশ্নের জন্য বিশেষ মনোযোগ পেতে পারে।
● প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে ‘হারিয়ে যাওয়া কালি-কলম’ থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ – কালি তৈরির পদ্ধতি, ফাউন্টেন পেনের আবিষ্কার, লেখকের প্রথম ফাউন্টেন পেন কেনার অভিজ্ঞতা, লিপিকুশলীদের অবস্থা। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ– দুই শ্রেণির পাঠকের স্বরূপ, পরিভাষা বিষয়ে লেখকের অভিমত, শব্দের অর্থের ত্রিবিধ রূপ।
● ‘সিরাজদ্দৌলা’ নাটকের প্রথম অংশে সিরাজ ও ওয়াটস্-এর কথোপকথন, নবাবের উদার অসাম্প্রদায়িক মনোভাব ('বাংলা শুধু হিন্দুর না, বাংলা শুধু মুসলমানের না...'),আর শেষপর্বে ঘসেটি বেগমের আগমন ও সিরাজ এবং লুৎফার সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব, বিশেষ ভাবে দেখতে হবে। নাটকের চরিত্রগুলিকেও পর্যালোচনা করতে হবে।
● ‘কোনি’ উপন্যাসে গঙ্গার ঘাটে বারুণী, ক্ষিতীশ সিংহের সঙ্গে জুপিটারের বিবাদ, লীলাবতী ও প্রজাপতি প্রসঙ্গ , মাদ্রাজের জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় বাংলা দলে কোনির অন্তর্ভুক্তি, সেখানে কোনির অভিজ্ঞতা ও সাফল্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
● প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানবিষয়ক রচনা (যেমন- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও কুসংস্কার, পরিবেশ রক্ষায় ছাত্র সমাজের ভূমিকা), উপযোগিতা ভিত্তিক রচনা (যেমন- ছাত্রজীবনে খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা, উৎসবের প্রয়োজনীয়তা, বাংলার উৎসব, সমাজ জীবনে মেলার গুরুত্ব) এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাভিত্তিক রচনা গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।
শেষ কথা— উত্তর লিখতে হবে কথ্য চলিত ভাষায়। এখনকার বাংলায় আলঙ্কারিক এবং তৎসম শব্দবহুল ভাষারীতি বর্জনীয়। কত অনায়াসে শিক্ষার্থী তার মনের ভাবকে প্রকাশ করতে পারছে, রচনা রীতিতে যুক্তিনিষ্ঠা এবং বিশ্লেষণ-দক্ষতা দেখাতে পারছে, তার উপরেই উত্তরপত্রের গুণগত মান নির্ভর করবে।
(লেখক যোধপুর পার্ক বয়েজ় স্কুলের বাংলার শিক্ষক)