স্বচ্ছ ভারত বা গঙ্গা শোধন নিয়ে যে পরিমাণ শোরগোল হয়েছে, তাতে সরলপ্রাণ নাগরিকরা নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন যে, এ বারের বাজেটে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারটা খুবই গুরুত্ব পাবে। সে আশা কতটা পূর্ণ হল? প্রথম কথা, মোট বাজেটের ০.২ শতাংশ টাকা (৩৬২৫ কোটি) মাত্র বরাদ্দ হয়েছে ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর জন্য। অঙ্কটা ২০১৪-১৫ সালের বিজেপি সরকারের পরিবর্তিত বাজেটে বরাদ্দের তুলনায় খানিকটা বেশি হলেও ওই বছরই পেশ করা মনমোহন সিংহ সরকারের বাজেটের তুলনায় (৪,২৫০ কোটি) বেশ খানিকটা কম! হ্যাঁ, ইউপিএ জমানাতেও ‘স্বচ্ছ ভারত’ ছিল, যদিও তখন তার পোশাকি নাম ছিল ‘নির্মল ভারত অভিযান’।
শুধু স্বচ্ছ ভারতের ক্ষেত্রে নয়, মনমোহন সরকারের শেষ বাজেট তো বটেই, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বরাদ্দের পরিমাণ অরুণ জেটলির নিজেরই পেশ করা প্রথম বাজেটের সংশোধিত হিসেবের তুলনায় কম। বস্তুত, পরিবেশের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সম্পর্কিত তিনটি দফতরেই এক দশা। ‘পানীয় জল ও সাফাই’ দফতরের বরাদ্দ (যার মধ্যে স্বচ্ছ ভারত ছাড়াও গ্রামীণ পানীয় জল পড়ে) জেটলির গত বছরের বাজেটের তুলনায় প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে, ‘জলসম্পদ, নদী উন্নয়ন ও গঙ্গা পুনরুজ্জীবন’ দফতরের বরাদ্দ কমেছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এবং ‘বন ও পরিবেশ’ দফতরে পাঁচ শতাংশ। বস্তুত সাম্প্রতিক অতীতে পরিবেশে ব্যয়বরাদ্দের পরিমাণ এতটা কখনওই কমেনি। পাশাপাশি সৌরশক্তি নিয়ে প্রচারের ঢেউ থাকলেও, পুনর্নবীকরণ শক্তি দফতরের বাজেট কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ। কেউ কেউ রাজ্যগুলির বর্ধিত বাজেট বরাদ্দের থেকে বাকি খরচের কথা বললেও তা খুব একটা ভরসা দিচ্ছে না।
আর একটু ভিতরে প্রবেশ করলে দুশ্চিন্তা বাড়ে। গঙ্গা শোধনের বাজেট ১৫০০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২১০০ কোটি হয়েছে বলে সংবাদপত্রে শিরোনাম হলেও ঘটনা হল, এই খাতের পুরো টাকাটাই আসার কথা ‘ন্যাশনাল ক্লিন এনার্জি ফান্ড’ থেকে, যা কয়লার ওপর সেস চাপিয়ে সরকার তুলবে। অভিজ্ঞতা বলে, এমন কান ঘুরিয়ে নাক ধরার পদ্ধতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাজ করে না। সেস-এর টাকা হয় ঠিকমত খরচ হয় না বা অন্য খাতে হয়, কাজের কাজ হয় না। তবু গঙ্গার ক্ষেত্রে বর্ধিত বাজেটের কথা বলা হয়েছে, দেশের বাকি নদীগুলি বাজেটে প্রায় ব্রাত্য। ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’ সংস্থার বক্তব্য অনুযায়ী দেশের নদীগুলির সার্বিক দূষণ আটকাতে বাজেটে কোনও স্পষ্ট পরিকল্পনা নেই, কিন্তু রয়েছে নদী সংযুক্তিকরণের ভাবনার প্রসার। এই খাতে প্রায় দশ গুণ বেশি ব্যয়বরাদ্দ হয়েছে (১০ কোটি থেকে ১০০ কোটি), যদিও নদী সংযুক্তিকরণের বিরোধিতা করছেন অধিকাংশ পরিবেশবিদ।
পরিবেশ ভাবনার উলটো পথে হাঁটার বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে পরিবেশ দফতরের বরাদ্দের গতিবিধিতে। আবহাওয়া পরিবর্তনের খাতে বর্ধিত ব্যয়বরাদ্দ নিয়ে হইচই হলেও মোট বরাদ্দ মাত্র ১৬০ কোটি, যেখানে দেশের এক একটি রাজ্যের ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন প্ল্যান’ প্রয়োগ করতে বেশ কিছু হাজার কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। বায়ু ও জল দূষণ রোধের খাতে সামগ্রিক ব্যয়বরাদ্দ দ্বিগুণের বেশি বাড়লেও (৯৭ কোটি থেকে ২৪০ কোটি), তার বড় অংশই বায়ুদূষণের ‘ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট’ করার জন্য— ৪ কোটি থেকে ১০৪ কোটি! পরিবেশবিদদের অভিমত, এই খাতে বরাদ্দ অর্থ দূষণ সত্যি-সত্যিই কমানোর বদলে কী করে আইনের ফাঁক দিয়ে দূষণ সামলানো যায়, তার ব্যবস্থা করতে ব্যবহৃত হয়। এবং, বার বার বলা হয়েছে, তেল-পোড়ানো গাড়িই বায়ুদূষণের বড় কারণ, অথচ গণ-পরিবহণের দিকে জোর দেওয়ার কোনও প্রতিশ্রুতি নেই। স্রেফ ৭৫ কোটি টাকা দিয়ে ‘ইলেট্রিক ভেহিকল’ তৈরি করার কথা বলা হয়েছে।
শেষে বলি বন ও বন্যপ্রাণী বিষয়টির কথা। এই খাতে বরাদ্দ ২০১৩-১৪’র তুলনায় প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমেছে (৯৭৩ থেকে ৩৬৩ কোটি), গত বছরের (৩৯৯ কোটি) তুলনায়ও কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ। বাঘের বরাদ্দ কমেছে ১৫ শতাংশ, হাতির বরাদ্দ কমেছে, অনেকখানি কমেছে গাছ লাগানোর বাজেট।
পরিবেশবিদরা মনে করছেন যে, অরুণ জেটলির সাম্প্রতিক বাজেট পরিবেশের ক্ষেত্রে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং গত কয়েক মাসে মোদী সরকারের কাজকর্মের দিকনির্দেশ খানিকটা এ দিকেই ছিল। এক দিকে যখন ‘স্বচ্ছ ভারত’ নিয়ে মিডিয়ায় দাপাদাপি, তখন নিঃশব্দে দেড়শোর কাছাকাছি প্রকল্পকে পরিবেশ অনুমতি এক দিনে দেওয়া হয়েছে, যারা জঙ্গল কেটে ‘উন্নয়ন’ করবে। পরিবেশবিদদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় স্তরের যাবতীয় পরিবেশ আইনকে সরল করার নামে দুর্বল করার চেষ্টা হচ্ছে। অর্থাৎ, মোদী সরকারের ভাবনায় পরিবেশ রক্ষার দাবি লঙ্ঘনের সংকেত গোড়া থেকেই ছিল, অর্থমন্ত্রী তাতে আর্থিক সিলমোহর লাগিয়েছেন মাত্র।