বিধ্বংস। আয়লার শিকার। সন্দেশখালি, সুন্দরবন। ২০১০।
২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাস। কোপেনহাগেন শহরে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের বেশ নীচে; কিন্তু শহরের বেলা সেন্টার-এ জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বৈঠক রীতিমত উষ্ণ। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে শুরু হল মধ্যরাতের ঐতিহাসিক বৈঠক। আমেরিকা, কানাডার মতো উন্নত দেশগুলি প্রস্তাব দিল দ্বীপপুঞ্জ রাষ্ট্রগুলিকে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার। ‘কাকে ঘুষ দিচ্ছেন, আপনাদের ঘুষ রাখবই বা কোন ব্যাংকে? দু’ডিগ্রি দূরস্থান, তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি বাড়লেই আমাদের গোটা দেশটা সমুদ্রের তলায় চলে যাবে,’ গর্জে উঠল টুভালু ও গ্রেনাডা-র মতো সিন্ধুতে বিন্দুর মতো থাকা ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলি।
অভিজ্ঞতা ২: মে ২০০৯। আয়লা ঝাঁপিয়ে পড়ল সুন্দরবনে। ক’ঘণ্টায় তছনছ কুমিরমারি, ছোটমোল্লাখালির মতো দ্বীপগুলি। পরের দিন: কুমিরের ভয় ত্যাগ করে গলা অবধি জলে দাঁড়িয়ে পানীয় জলের জন্য হাহাকার করছেন মানুষ। ‘আমার পরিবারের দু-জন বাঘের থাবায় প্রাণ দিয়েছেন, আমরা সুন্দরবন ছাড়িনি, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন বাঘের চেয়েও বড় বিপদ,’ বললেন এক দ্বীপবাসী, সুন্দরবন থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে কলকাতায় বসে।
অভিজ্ঞতা ৩: মাথার ওপর চড়া রোদ্দুর, পাশে অন্তহীন জল। ভটভটি নৌকার পিছন থেকে ঘুরে ঘুরে উঠছে ডিজেল পোড়া কালো ধোঁয়া। মালদার পঞ্চানন্দপুর থেকে গঙ্গা পার হয়ে নৌকা চলেছে ঝাড়খণ্ডের দিকে। মাঝখানে ইতিউতি বেশ কিছু দ্বীপখণ্ড। কয়েক লক্ষ মানুষের বাস, তাঁরা জানেন না আর ক’দিন থাকতে পারবেন। ‘কবে জল বাড়বে আর এই আস্তানা জলের তলায় যাবে, কে জানে?’ নির্বিকার স্বরে জানালেন এক বৃদ্ধ।
অভিজ্ঞতা ৪: ‘সরে আসুন, সরে আসুন’, চেঁচিয়ে উঠলেন মধ্যবয়সি মহিলা। ‘এখুনি পাড় ভেঙে পড়বে।’ ‘কী করে বুঝলেন? এখন তো ঠিকই আছে!’ তখনই ব্রহ্মপুত্রের নদীগর্ভে ধসে পড়ল সেই জায়গাটা, যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম! ‘এ তো কম দেখছেন, দূরের দ্বীপগুলোর হাল আরও খারাপ। প্রত্যেক দিন কত মানুষ যে ঘরহারা হচ্ছেন!’ পাড়ে দাঁড়িয়ে অস্ফুটে বললেন এক বৃদ্ধ, ব্যাকগ্রাউন্ডে তখন সদ্য সরিয়ে নেওয়া দরমা আর টালির ঘরের দাগ।
অভিজ্ঞতাগুলি স্রোতের মতো ভেসে এল এ বারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের স্লোগান দেখে: ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও ছোট দ্বীপপুঞ্জ’। দ্বীপপুঞ্জ বলতে সাধারণ ভাবে দ্বীপরাষ্ট্রগুলির কথা বলা হলেও বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে থাকা দ্বীপগুলির ক্ষেত্রেও বিপদ কম নয়। যেমন আন্দামান-নিকোবর, লাক্ষাদ্বীপ, সুন্দরবন।
১৯৯২ সালে রিয়ো ডি জ্যানেইরো’তে প্রথম আলোচনায় উঠে আসে দ্বীপপুঞ্জগুলির বিপন্নতার কথা, তার পর ১৯৯৪ সালে বার্বাডোজ-এ বসে দ্বীপপুঞ্জগুলির সমস্যা নিয়ে প্রথম বিশ্ব সম্মেলন। তৈরি হয় স্মল আইল্যান্ডস ডেভেলপিং স্টেটস’ বা ‘অ্যালায়েন্স অব স্মল আইল্যান্ড স্টেটস’-এর মতো জোট। প্রধান লক্ষ্য জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বিপদ সম্বন্ধে একযোগে বাকি পৃথিবীর কাছে দরবার করা। শিল্পোন্নত দেশগুলির তুলনায় একশো ভাগের এক ভাগ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে এই দ্বীপগুলি, কিন্তু ঝড়ঝঞ্ঝা, সমুদ্রের জলের তল বৃদ্ধি থেকে শুরু করে নানা জলবায়ু-কেন্দ্রিক বিপর্যয়ের একটা বড় অংশের ঠিকানা হয় এরা। ‘আমাদের দ্বীপটি এত ছোট যে প্রায় এক দিক থেকে ঢিল ছুড়লে অন্য দিকের সমুদ্রে পড়ে। কোনও পাহাড় নেই, উঁচু জায়গা নেই। বন্যা, ঝড় বা অন্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে পালানোর উপায় নেই, সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া। তাই আমরা ক্যাবিনেটে আলোচনা করছি, যদি কোনও প্রতিবেশী দেশে জমি কেনা যায়,’ বললেন টুভালুর এক রাজনীতিক। ‘মলদ্বীপের মতো দ্বীপরাষ্ট্রের প্রায় পুরোটাই নিচু অঞ্চল; যদি সমুদ্রের জল এ-ভাবে বাড়তে থাকে, হয়তো আর ক’বছরের মধ্যে ডুবে যাবে। ওরা তো ইতিমধ্যেই দেশকে অস্ট্রেলিয়ায় তুলে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে সুন্দরবনের মানুষকেও সদলবল মেনল্যান্ডে জমি কিনতে বা খুঁজতে হবে,’ মনে করেন জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ সালিমুল হক, যিনি বেশ কিছু দ্বীপপুঞ্জ রাষ্ট্র সহ অনুন্নত দেশগুলির প্রধান পরামর্শদাতা। তাঁর মতে, যে সব বিষয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ ফল, সেগুলিও নজর করা দরকার। ‘সুন্দরবন অঞ্চলে জল ও জমির লবণাক্ততা বাড়ছে, কৃষি ও খাদ্যের সমস্যা বাড়ছে, বাড়ছে সুন্দরবন থেকে চলে আসার প্রবণতা। জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই জলবায়ু পরিবর্তন ছাপ ফেলছে,’ পোল্যান্ডের ওয়ারশ শহরে জলবায়ু পরিবর্তনের শেষ বিশ্ব সম্মেলনে আড্ডায় বা সম্প্রতি ই-মেলে সালিমুল সাহেবের বক্তব্য। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সুগত হাজরার কথায়, বিশ্ব জুড়ে সমুদ্রতল বৃদ্ধি বছরে গড়ে ৩.২ মিলিমিটার মতো হলেও ভারতীয় সুন্দরবনে তা প্রায় ৮ মিলিমিটার, কারণ এখানে মাটি বসে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সুন্দরবনে তা আরও বেশি। ইতিমধ্যেই লোহাচরা বা ঘোড়ামারার মতো দ্বীপ পুরো বা অনেকটাই ডুবে গেছে। অধ্যাপক হাজরার মতো আরও অনেক বিশেষজ্ঞ তাই মনে করেন, দুই বাংলা একযোগে জলবায়ু পরিবর্তন সামলানোর চেষ্টা না করলে কোনও সুন্দরবনকেই বাঁচানো যাবে না। ‘যাদের বিন্দুমাত্র ক্ষমতা আছে, এখনই তারা সুন্দরবন ছেড়ে কলকাতার উপান্তে রাজপুর সোনারপুর বা অন্যান্য অঞ্চলে ঠাঁই গাড়ছেন।’ বললেন আর এক বিশেষজ্ঞ। রাজপুর সোনারপুরে দুটো বাড়ির দরজায় টোকা মারলে অন্তত একটিতে এক জন সুন্দরবনবাসীর দেখা মিলবে।
যদি শুধু সুন্দরবনের এই হাল হয় তবে সারা দেশের ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার পরিস্থিতি বোঝা কঠিন নয়। শুধু ব্রহ্মপুত্রের দ্বীপে অসহায় প্রতীক্ষায় আছেন তিরিশ লক্ষ মানুষ, অন্যান্য নদীর চরে আরও বহু লক্ষ; কখন পরের ঝড় তছনছ করে দিয়ে যাবে তাঁর ঘর, হয়তো হারাবেন আর এক জন কাছের আত্মীয়কে, ফের নিঃস্ব, নিঃসহায়!
১৯৯৪ সালে বার্বাডোজ সম্মেলনের প্রায় দু’দশক পরে বাকি পৃথিবী মানল ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র ও দ্বীপ অঞ্চলগুলির বিপন্নতা। সম্প্রতি প্রকাশিত ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)-এর পঞ্চম অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট জানাল, ‘ছোট দ্বীপপুঞ্জ ও সমুদ্রের তীরবর্তী নিচু অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মৃত্যু, দুর্ঘটনা, শারীরিক অসুস্থতা ও জীবিকাহনির যথেষ্ট বিপদ রয়েছে।’ এবং বহু ক্ষেত্রেই বিপদ আসতে পারে ‘অপ্রত্যাশিত’ মাত্রায়। অথচ তথাকথিত শিল্পোন্নত দেশগুলিতে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমার বদলে ক্রমেই বাড়ছে!
দ্বীপপুঞ্জগুলির আজকের বিপদ অন্যান্য অঞ্চলের আগামী দিনের বিপদসংকেত। সুন্দরবন না বাঁচলে কলকাতা বাঁচবে না, ঢাকা বাঁচবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই অঞ্চলগুলির যে ক্ষতি হয়েছে, বাকি পৃথিবীর তা মিটিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে। তা না করে শুধু স্লোগান দিলে দ্বীপপুঞ্জগুলি বাঁচবে না, বাকি পৃথিবীও মরবে।
কৃতজ্ঞতা: এনভায়রনমেন্ট, ইমার্জিং ক্রাইসিস; বিশ্বজিত্ মুখোপাধ্যায়।