পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্ব নতুন করে হবে কি হবে না, তা নিয়ে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আলোচনা শুরু হয়েছিল। বিশেষত শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি ভবনে সার্ক রাষ্ট্রের প্রধানদের আমন্ত্রণ জানিয়ে শান্তিরই বার্তা দিয়েছিলেন নতুন প্রধানমন্ত্রী। নওয়াজ শরিফের সঙ্গে মোদীর বৈঠকও বেশ ভালই হল। সেই সদর্থক বার্তা নিয়ে দু’দেশের কূটনীতিকরা শান্তির পায়রা ওড়াতে শুরু করলেন। কিন্তু তার কিছু দিনের মধ্যে কাশ্মীরের হুরিয়ত নেতাদের দিল্লির পাক হাইকমিশনে ডাকা নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গেল। তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল মোদী সরকার। অতএব, ঘচাং ফু! বিদেশ সচিবদের নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করে দিল ভারত। সীমান্তে গোলাবর্ষণ। পাক জঙ্গি অনুপ্রবেশও শুরু। এই ঘটনায় কট্টরবাদীরা খুশি। বাপ কা বেটা নরেন্দ্র মোদী। নভেম্বরে কাশ্মীর নির্বাচনে জম্মুর হিন্দু ভোট সুসংহত করতে মরিয়া অমিত শাহ।
আমার কিন্তু মনে হয়, পাকিস্তান আছে পাকিস্তানেই। গত ষাট বছর ধরে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কটা একটা তৈলাক্ত বাঁশের উপর বাঁদরের ওঠানামা। অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর প্রথম বিদেশ সফর ছিল কলম্বো। সার্ক-সম্মেলন। সেই সফরে তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বাজপেয়ীর বৈঠক হয় তাজ সমুদ্র হোটেলে। সে দিন অকুস্থলে হাজির ছিলাম। দুই শীর্ষনেতার বৈঠকের পর হোটেলের কনফারেন্স হলে টেবিলের উপর জাতীয় পতাকা লাগিয়ে বাজপেয়ী সাংবাদিক সম্মেলন করলেন। ঘোষণা করলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে তিনি শান্তি আলোচনা শুরু করতে চান। কাশ্মীর-সহ সব বিষয়ে আলোচনা করতে তিনি প্রস্তুত। এর পরে ওই একই কক্ষে সাংবাদিক বৈঠক করতে এলেন নওয়াজ শরিফ। একই চেয়ার, একই টেবিল, শুধু পাক নিরাপত্তা বাহিনী এসে টেবিলের উপর পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা লাগাল। আর ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ভারতের জাতীয় পতাকা তুলে নিয়ে গেল। সেই সাংবাদিক বৈঠকে নওয়াজ শরিফ বললেন যে পাকিস্তানের সঙ্গে বৈঠক সম্পূর্ণ ব্যর্থ। বৈঠকের নিট ফল শূন্য। কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। সেই কক্ষের একদম পিছনে দাঁড়িয়েছিলাম বাজপেয়ীর মিডিয়া উপদেষ্টা অশোক ট্যান্ডনের সঙ্গে। ট্যান্ডন বললেন, “কী অদ্ভুত লোক! বৈঠকের ভিতর এত ক্ষণ শান্তির কথা বললেন। এমনকী বলছিলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে দু’দেশের মধ্যে। আর সেই লোকটাই সাংবাদিক বৈঠকে সম্পূর্ণ উল্টো সুর গাইছেন। কী কাণ্ড!”
এটা হল ১৯৯৮ সালের জুলাই মাসের কথা। এর পর সে বছরই সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ সভায় যোগ দিতে গেলেন বাজপেয়ী। সেখানে আবার দেখা দুই নেতার মধ্যে। নিউ ইয়র্ক প্যালেস হোটেলে যৌথ সাংবাদিক বৈঠক হল। সে দিনের সেই সাংবাদিক বৈঠকেও হাজির ছিল এই প্রতিবেদক। লাহৌর বাসযাত্রার কর্মসূচি নিউ ইয়র্কে সে দিন ঘোষণা হয়েছিল। মজার বিষয় হল, কলম্বোতে সেনাবাহিনী ও মোল্লাতন্ত্রের চাপে যে নওয়াজ শরিফ প্রকাশ্যে শান্তির কথা বলতে ভয় পেয়েছিলেন, আমেরিকা ও ভারতের চাপে নিউ ইয়র্কে সেটা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
আসলে নওয়াজ শরিফ শান্তি চান। সে দিনও চেয়েছিলেন। আজও চান। কিন্তু বেনজিরকে হারিয়ে ’৯৭ সালে তিনি যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন, সে দিনের নওয়াজ আর আজকের নওয়াজ কিন্তু এক মানুষ নন। নওয়াজ দেখেছেন যে লাহৌর যাত্রা করতে গেলে তাঁকে কী খেসারত দিতে হয়েছে। পারভেজ মুশারফ ছিলেন তখন সেনাপ্রধান। তিনি কারগিল যুদ্ধের স্থপতি। তাঁর নেতৃত্বে হয়ে গেল ক্যু। নওয়াজকে সরিয়ে তিনি ক্ষমতাসীন হলেন। পাকিস্তানে সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। এখন লাহৌর থেকে ইসলামাবাদে এসে ইমরান খান অবস্থান ধর্না দিচ্ছেন। নওয়াজকে সরিয়ে নতুন সরকার গড়তে চাইছেন। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আইএসআই ও মোল্লাতন্ত্রের চাপে নওয়াজ শরিফও বুঝতে চাইছেন, ভারতের সঙ্গে এখন বেশি শান্তি প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে নিজের চাকরি না খোয়ানোই বাঞ্ছনীয়। পাকিস্তানের জনসমাজে এমনিতেই মধ্যবিত্ত শ্রেণিটা খুব দুর্বল। সমাজের ধনী ও দরিদ্রের মেরুকরণ খুব তীব্র। যেটুকু মধ্যবিত্ত সমাজ আছে, সেটা মূলত সেনাবাহিনীতেই চাকরি করে। এই মধ্যবিত্তের সমর্থন কিন্তু সবসময় সেনাবাহিনী পায়।
বাজপেয়ীর সঙ্গে লাহৌরে বাসযাত্রায় গিয়েছিলাম। সে দিন পৌঁছনোর পর হেলিপ্যাডে নওয়াজ শরিফ স্বাগত জানালেও তিন সেনাপ্রধানই কিন্তু বাজপেয়ীকে বয়কট করেছিলেন। পাকিস্তানের সংবাদপত্র ‘দ্য নিউজ’-এ এই খবর প্রকাশিত হয়। তৎকালীন পাক হাইকমিশনার ছিলেন জি পার্থসারথি। ভারতীয় কূটনীতিকদের বিষয়টি জানালে তাঁরা বলেন, এই বিষয়টিকে বেশি প্রচার না করাই ভাল। তাতে শান্তিপ্রক্রিয়ার ক্ষতি হবে। এমনকী, লাহৌর দুর্গে বাজপেয়ী যখন গিয়েছিলেন তাঁর কনভয় নিয়ে, তখন কিছু মৌলবাদী তাঁকে কালো পতাকা পর্যন্ত দেখিয়েছিলেন। ’৯৬ সালে শ্রীনগর গিয়েছিলাম জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভা নির্বাচন কভার করতে। ’৯৭-তে পাকিস্তানে গিয়েছিলাম সাধারণ নির্বাচন কভার করতে। ভারতের কাশ্মীরে গিয়ে দেখেছি, ওখানকার মানুষ কিন্তু সকলে পাকিস্তান-পন্থী নন। তাঁরা যে সকলেই পাকিস্তানের সঙ্গে এক হতে চান, তা কিন্তু নয়। কিন্তু পাকিস্তানে গিয়ে দেখেছি ওখানে মানুষের মধ্যে তীব্র অবদমিত একটা ইচ্ছা থেকে গিয়েছে। এটা বোধহয় ’৮৭ সালের পর থেকেই রয়ে গিয়েছে এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা সেই আবেগকে মূলধন করেছেন। কারণ দেশের মূল্যবৃদ্ধি, দারিদ্রের মতো সমস্যাগুলিকে যাতে দূরে সরিয়ে রাখা যায়। এটা কী করে বোঝা যায় জানেন? যখন দেখি পাকিস্তানে একটি সেলুনের নাম ‘কাশ্মীর সেলুন’। ‘কাশ্মীর বিউটি পার্লার’ অথবা ‘কাশ্মীর প্যালেস হোটেল’-এর নামও দেখেছি। এই ছোট ছোট নামকরণ থেকে বোঝা যায়, এই নামকরণের মধ্যে লুকিয়ে আছে সেই অবদমিত মনস্তত্ত্ব।
সুতরাং আমরা ঘরপোড়া গরু। কিছুতেই ভাবতে পারি না যে নরেন্দ্র মোদী নামক এক অরণ্যদেব এসেছেন। তিনি এসে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করে ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্কে ঠিক করে দেবেন। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কারগিল ধরলে চারটি যুদ্ধ হয়েছে। এখন দু’দেশই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র। তাই যুদ্ধের আশঙ্কা হয়তো কমেছে। কিন্তু ছায়াযুদ্ধের অবসান হবে এবং সেনাবাহিনী, আইএসআই ও মোল্লাতন্ত্র ধ্বংস করে দিয়ে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ধ্বজা উড়বে, এটা ভাবতে একটু কষ্ট হয়। মনমোহন সিংহের সঙ্গেও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বৈঠক হয়েছে আমেরিকাতেই। নিউ ইয়র্ক প্যালেস হোটেলে। সেই হোটেলেই শিবশঙ্কর মেনন সাংবাদিক বৈঠক করতে এসেছিলেন। সে দিনও ছিলাম ওই সাংবাদিক বৈঠকে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এ বার কি তা হলে শান্তিপর্ব শুরু? মেনন জবাব দিয়েছিলেন, আমাদের কূটনীতিকদের কাজ হল, চেষ্টাটাকে নিরন্তর চালিয়ে যাওয়া। যেটাকে আমরা বলি এনগেজমেন্ট। শান্তিপর্ব হবে কি হবে না, জানি না। দু’দেশের মধ্যে এই এনগেজমেন্ট যদি থাকে, সেটাও কিছু কম নয়।
আবার সেপ্টেম্বর আসছে। এ বার নরেন্দ্র মোদী নিউইয়র্ক যাচ্ছেন। আশা করা যায়, এই নিউ ইয়র্ক সফরে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে নওয়াজ শরিফের বৈঠক হবে। দু’পক্ষই বলবে, যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। কিন্তু অতঃকিম? মেননের ভাষাতেই হয়তো অজিত দোভাল বলবেন, ‘দ্য মিটিং ইজ ফ্রুটফুল। ফারদার ডিসকাশন অ্যান্ড এনগেজমেন্ট উইল কনটিনিউ।’