তাঁহার জীবনের প্রথম রেল বাজেটটি পেশ করিতে উঠিয়া সুরেশ প্রভু বলিয়াছিলেন, বিপদে পড়িলে মানুষ ‘প্রভু’, অর্থাৎ ঈশ্বরের শরণ লয়। কিন্তু, রেলের ভাগ্য ফিরাইতে যাহা করিবার, তাহা ‘এই প্রভু’, অর্থাৎ স্বয়ং রেলমন্ত্রীকেই করিতে হইবে। রসিকতা? হইলেও, তাহাতে মনের গহন কোণের একটি প্রতিবিম্ব ধরা পড়িয়াছিল। অবশ্য, শুধু সুরেশ প্রভুই নহেন, প্রায় সব রাজনীতিকেরই মনের কথা হইল, সর্ব ধর্ম পরিত্যাগ করিয়া তাঁহার শরণ লইলেই তিনি রক্ষা করিবেন। এবং, সমস্যা যে মাপেরই হউক না কেন, সব কিছুর সমাধান তাঁহারাই করিবেন। বহু রাজনীতিক মনের এই ভাবটি প্রচ্ছন্ন রাখিতে পারেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা প্রকাশ করিয়া ফেলেন। কিন্তু, সুরেশ প্রভু বিষয়টিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন স্তরে লইয়া গেলেন। রেল সফরকালীন যে কোনও অসুবিধার সম্মুখীন হইয়া টুইটারে তাঁহাকে বার্তা দেওয়ার মিনিট দুয়েকের মধ্যে সমস্যার সমাধান হইতেছে। কাহার শিশুর জন্য গরম দুগ্ধের ব্যবস্থা হইতেছে, কোনও বৃদ্ধের জন্য অজ্ঞাত স্টেশনে ট্রেন দীর্ঘ ক্ষণ দাঁড়াইতেছে, হুইলচেয়ার আসিতেছে। সম্প্রতি কোনও এক ট্রেনে একটি দুই বৎসরের শিশু গুরুতর অসুস্থ হইয়া পড়ায় তাহার অসহায় বাবার বন্ধু রেলমন্ত্রীকে টুইট করেন, এবং মন্ত্রিবরের তৎপরতায় শিশুটির প্রাণরক্ষা হয়। প্রতিশ্রুতি সব নেতাই দেন, কিন্তু দুই মিনিটের মধ্যে সাহায্যপ্রার্থীর পার্শ্বে দাঁড়াইয়া প্রভু নিশ্চিত ভাবেই রেকর্ড করিয়াছেন। তাঁহার তৎপরতায় বহু যাত্রী তীব্র, বা ততখানি তীব্র নহে এমন, সংকট হইতে রক্ষা পাইয়াছেন। ভারতীয় রেলের ইতিহাসে তো বটেই, গোটা দেশেই এমন ঘটনা অ-পূর্ব।
এবং, তাহার জন্য মন্ত্রিবরের কোনও প্রশংসাই প্রাপ্য নহে। দেশের রেলমন্ত্রীর হাতে যদি যাত্রীদের অভিযোগ পাওয়ামাত্র তাহার ব্যবস্থা করিবার মতো সময় থাকে, তবে সেই সময়টি রেলের নীতিনির্ধারণের কাজে ব্যয় করাই বিধেয়। যাত্রীদের প্রতিটি অভিযোগের নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন, ভারতীয় রেলকে যাত্রিবান্ধব করিয়া তোলা প্রয়োজন— সবই ঠিক, কিন্তু সেই কাজটি স্বয়ং রেলমন্ত্রীর করণীয় নহে। রেলমন্ত্রীই ভারতীয় রেলের সর্বাধিনায়ক। আদর্শ নেতা কখনও প্রতি মুহূর্তের খুঁটিনাটির ভার নিজের হাতে রাখেন না। তাহা যোগ্য অধস্তন সহকর্মীর উপর ন্যস্ত করেন। সুরেশ প্রভুরও কর্তব্য, টুইটারের মাধ্যমে আসা যাত্রীদের অভিযোগের দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য একটি কাঠামো গড়িয়া দেওয়া। তিনি সেই কাঠামোর অংশী হইবেন না। তিনি বড় জোর নজর রাখিবেন, কাঠামোটি ঠিক ভাবে কাজ করিতেছে কি না।
ভারতের সরকারি দফতর সম্বন্ধে যাঁহাদের সম্যক ধারণা আছে, তাঁহারা মুচকি হাসিয়া বলিবেন, স্বয়ং মন্ত্রিমহোদয় দেখিতেছেন বলিয়াই যাত্রীদের অভিযোগগুলির দ্রুত সুরাহা হইতেছে। কাঠামো গড়িয়া মন্ত্রী সরিয়া গেলে সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটির গঙ্গাপ্রাপ্তিতে সময় লাগিবে না। কথাটি ভিত্তিহীন নহে। এবং সেই কারণেই, সুরেশ প্রভুর সম্মুখে চ্যালেঞ্জটি কঠিনতর। প্রকৃত নেতা নিজে সর্ব কার্যে পারদর্শী হইবেন, তাহা প্রত্যাশিত। কিন্তু সেই পারদর্শিতা যদি তাঁহার পায়ের শৃঙ্খল হইয়া দাঁড়ায়, তবে মুশকিল। তিনিই যোগ্য নেতা, যিনি অচলায়তনে গতি আনিতে পারেন। সরকারি গাফিলতির অভ্যাস হইতে কর্মীদের বাহির করিয়া আনিতে শুধু হুকুম যথেষ্ট হইবে না, তাঁহাদের অনুপ্রাণিত করিতে হইবে। সুরেশ প্রভুর বর্তমান অতিসক্রিয়তার পিছনে যদি তেমন বৃহত্তর পরিকল্পনা থাকে, তবে অন্য কথা। নয়তো, তাঁহার সুপারম্যান হইয়া উঠিবার চেষ্টাটি আখেরে ক্ষতিকারক হইবে। প্রভু স্মরণে রাখিতে পারেন, নরকের পথটি হামেশাই সদিচ্ছা দিয়া বাঁধানো থাকে। যাত্রীদের সাহায্য করিবার ইচ্ছাটি মহৎ, কিন্তু সেই ইচ্ছাকে যথার্থ খাতে না বহাইতে পারিলে বিপদ।