অধিকারের পালাবদল। বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর। ১৩ মে, ২০১১।
তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে এসেই আমাদের রাজ্যটা এমন লুটেপুটে খাওয়ার মতো এলোমেলো হয়ে গেল, এমন দাবি ঘোর সিপিএম সমর্থকও করবেন বলে মনে হয় না। মাত্র তিন বছরে কি লোকাল কমিটির প্রবল পরাক্রম ভোলা যায়? তোলাবাজি থেকে সিন্ডিকেট, সব ঐতিহ্যই বাম আমলের। অবশ্য, যেখানে যা ঘটছে, মুখ্যমন্ত্রী নিজে ‘এনকোয়্যারি’ করে বলে দিচ্ছেন ‘ও কিছু নয়, সামান্য ঘটনা’— এই অ্যাক নতুন। বাম আমলেও দোষীদের আড়াল করা হত বিলক্ষণ, কিন্তু সেই কাজটা জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে করতে হয়নি। তবে, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যখন সভা পরিচালনা থেকে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, সবই নিজের হাতে করেন, এটাই বা বাদ যায় কেন?
কিন্তু সবই যদি বামফ্রন্ট আমলের ঐতিহ্য হয়, তা হলে হঠাৎ এমন ‘গেল, গেল’ রব উঠছে কেন? সিপিএম-এর ষড়যন্ত্র, নাকি এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যমের চক্রান্ত? সম্ভবত এই দুটোর একটাও প্রকৃত কারণ নয়। তোলাবাজি পশ্চিমবঙ্গে একটা বড় সমস্যা। তোলাবাজি শব্দটা একটু বড় অর্থে ব্যবহার করছি। যে কোনও ক্ষেত্রে, যেখানে কোনও রকম অধিকার ছাড়াই কেউ আর্থিক সুবিধা দাবি করে— মূলত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকার সুবাদে— সেটাই তোলাবাজি। সরাসরি টাকা দাবি করা একটা গোত্রের তোলাবাজি, জোর খাটিয়ে ইট-বালি-সিমেন্ট জোগান দেওয়ার কাজ, কারখানায় শ্রমিক জোগানোর কাজ বা রেলের সাইডিং থেকে মাল খালাস করার কাজ দখল করা আর এক গোত্রের। দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি নিয়ে কেউ আপত্তি করে বলতে পারেন, এটা তো অর্থনৈতিক বিনিময় মাত্র— হয় পণ্য, নয় পরিষেবার বিনিয়মে টাকা নেওয়া। একে তোলাবাজি বলার কারণ দুটো: এক, প্রায় সব ক্ষেত্রেই কাজটি গা-জোয়ারি করে দখল করা হয়, ফলে লগ্নিকারীর পছন্দ-অপছন্দের জায়গা থাকে না; দুই, প্রায় সব ক্ষেত্রেই খোলা বাজারের চেয়ে অনেক বেশি দামে পণ্য বা পরিষেবা কিনতে বাধ্য হন তাঁরা। এই তোলাবাজির কল্যাণে পশ্চিমবঙ্গের নাভিশ্বাস উঠছে।
কিন্তু, বামফ্রন্টের আমলেও এই তোলা-রাজ ছিল, তৃণমূল কংগ্রেসের আমলেও আছে। যদি ধরে নেওয়া যায় যে তোলার হার অপরিবর্তিত আছে, মানে আমি ১০০ টাকা উপার্জন করলে দুই জমানাতেই ১৫ টাকা তোলা দিতে হয়, তবে বিনিয়োগের ওপর তোলা যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, সেটাও দুই জমানাতেই সমান হওয়া উচিত। তা হলে নতুন আমলে এমন কী হল যাতে হলদিয়ার জাহাজের মাল খালাসের কারখানা থেকে বর্ধমানের ইস্পাত কারখানা, বা রানিগঞ্জের ইস্টার্ন কোলফিল্ডস লিমিটেড, সব সংস্থাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে?
এই প্রশ্নের একটা সহজ উত্তর হতে পারে— আগের আমলের তুলনায় এখন তোলার হার বেড়েছে। উত্তরটা ঠিক কি না, জানার উপায় নেই, এটা অনুমানমাত্র। কিন্তু, বাম আমলের সঙ্গে বর্তমান আমলের যে পার্থক্য চোখে পড়বেই, সেটা হল, বাম আমলে তোলা আদায় গোত্রের গা-জোয়ারি অনেক বেশি সংগঠিত ছিল, অর্থাৎ কোথায় কে কত টাকা তোলা আদায় করবে, তা আগে থেকেই জানা সম্ভব ছিল, বর্তমান আমলে এই খবরগুলো জানা সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়েছে। বস্তুত, দুই আমলে তোলা আদায়ের ঘটনা বাইরে থেকে দেখতে এক রকম হলেও আসলে দুটো আলাদা। এখন পশ্চিমবঙ্গে তোলাবাজি ভয়ানক অনিশ্চিত একটা ব্যাপার।
গত শতকের গোড়ার দিকে মার্কিন অর্থনীতিবিদ ফ্র্যাঙ্ক নাইট ব্যাখ্যা করেছিলেন, ঝুঁকি আর অনিশ্চয়তা দুটো আলাদা ব্যাপার। ব্যবসার পক্ষে দুটোই ক্ষতিকর, কিন্তু ফারাক হল, প্রথমটা মাপা যায়, আর দ্বিতীয়টা যায় না। ধরুন, এই বর্ষায় আপনি খোলা আকাশের নীচে একটা অনুষ্ঠান করতে চান, বৃষ্টি হলে যেটা সম্পূর্ণ ভেস্তে যাবে এবং আপনার ক্ষতি হবে। আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস থেকে আপনি বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা জেনে নিতে পারেন। অর্থাৎ, আপনার ক্ষতির সম্ভাবনাটি আপনার জানা। কাজেই, এটা ঝুঁকি। কিন্তু পাগলা ষাঁড় এসে আপনার অনুষ্ঠান লণ্ডভণ্ড করে দেবে, সে সম্ভাবনা কত— আপনার সেটা জানার কোনও উপায় নেই। এটাই হল অনিশ্চয়তার দুনিয়া।
ঝুঁকি নিতে বিনিয়োগকারীদের আপত্তি নেই, কারণ কোন ঝুঁকিতে প্রত্যাশিত ক্ষতির পরিমাণ কত, সেটা হিসেব কষে নেওয়া যায়। সেই অঙ্কটা ব্যবসার খরচের খাতায় ঢুকে পড়ে, এবং ব্যয়-লাভের হিসেবে প্রতিফলিত হয়। বাম আমলের তোলাবাজি যেমন। যেহেতু তোলা দিতে হওয়ার সম্ভাবনা এবং তার সম্ভাব্য পরিমাণ আগেই জানা থাকত, এই খাতে ব্যয়ের হিসেব কষতেও অসুবিধে ছিল না। সমস্যা অনিশ্চয়তা নিয়ে। অনিশ্চিত পরিস্থিতির দরুন ব্যয়ের পরিমাণ কত হবে, সেটা যেহেতু বোঝার উপায় নেই, ফলে সেই ব্যয় মিটিয়েও লাভ হবে কি না, সেটাও অনুমানের বাইরে। এই পরিস্থিতিকে বিনিয়োগকারীরা এড়িয়ে চলতে চান।
বাম জমানা থেকে তৃণমূল জমানায় প্রবেশ করে পশ্চিমবঙ্গ আসলে ঝুঁকি থেকে অনিশ্চয়তার দুনিয়ায় এসে পৌঁছেছে। কোন দেবতা কত কাঞ্চনমূল্যে সন্তুষ্ট হবেন, অভিজ্ঞ লোকরা বলেন, বাম আমলে সেটা জানার উপায় ছিল। সংগঠিত চরিত্রের কারণে এটাও জানা ছিল যে লোকাল কমিটি ছাড়পত্র দিলে আর সমস্যা নেই— ফের কোনও পক্ষ টাকা দাবি করতে হাজির হবে না। এবং, যাঁরা আলিমুদ্দিন স্ট্রিট অবধি পৌঁছতে পারতেন, তাঁরা এক ধরনের নিরাপত্তাও পেতেন— ওপর মহলের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করার দুঃসাহস খুব বেশি কারও ছিল না। তৃণমূল কংগ্রেসের ‘অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র’ এই সব হিসেব ঘেঁটে দিয়েছে। জামুড়িয়ার শ্যাম স্টিলের উদাহরণটিই পরিস্থিতি বোঝার জন্য যথেষ্ট হবে। শাসক দলের দুই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বে নাভিশ্বাস উঠছিল সংস্থাটির। ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে সংস্থার কর্ণধার স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে দরবার করেন, স্থানীয় নেতাদের বিবিধ উপদ্রব নিয়ন্ত্রণের আর্জি নিয়ে। মুখ্যমন্ত্রী নাকি ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশও দিয়েছিলেন। তাতেও যে কাজ হয়নি, তার প্রমাণ খবরের কাগজের পাতায় প্রতি দিন মিলছে। হলদিয়ার এবিজি গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত সংস্থাটিকে রাজ্যছাড়া করতে সক্ষম হয়েছিল। দলের ওপর প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, এটুকু বোধ হয় বিনিয়োগকারীরা এত দিনে মেনেই নিয়েছেন। কিন্তু, দলের ওপর দলীয় নেতৃত্বেরও নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, এটা মানা মুশকিল। সেই নিয়ন্ত্রণহীনতা যে বিপুল অনিশ্চয়তা তৈরি করে, তা ব্যবসার অনুকূল নয় নিশ্চয়ই।
এই অনিশ্চয়তা চরিত্রগত ভাবেই ক্রমবর্ধমান। তোলা কে আদায় করবে, সেই কাঠামোটি যদি যথেষ্ট স্পষ্ট না হয়, এবং দলের গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠীর ওপর যদি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তবে একই ব্যবসা থেকে একাধিক লোকের তোলা আদায় করতে বাধা নেই। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে, যেখানে তোলাবাজের তুলনায় লাভজনক ব্যবসার সংখ্যা নিতান্ত কম। ঘটছেও তাই— যেখানে টাকার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, ভিড় বাড়ছে সেখানেই। তৈরি হচ্ছে নতুন গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠী, এবং তাদের দাবিদাওয়া না মিটিয়ে ব্যবসা করার কোনও উপায় পশ্চিমবঙ্গে নেই।
ম্যানকার ওলসন নামে এক মার্কিন অর্থনীতিবিদ দুই গোত্রের ডাকাতের কথা বলেছিলেন— ভ্রাম্যমাণ ডাকাত আর বসবাসকারী ডাকাত। ভ্রাম্যমাণ ডাকাত আজ এক অঞ্চলে ডাকাতি করে, কাল অন্য অঞ্চলে। সে কোনও জায়গায় ফিরে আসে না। ফলে, সম্পূর্ণ লুটেপুটে নিয়ে যাওয়াই তার একমাত্র উদ্দেশ্য। অন্য দিকে, বসবাসকারী ডাকাত একই জায়গায় থেকে যায়, এবং একই জনগোষ্ঠীকে বার বার শোষণ করে। ফলে, সেই অঞ্চলের মানুষ যাতে বেঁচেবর্তে থাকতে পারে, এবং পরের বার ডাকাতি করতে এলে যাতে কিছু সম্পদ পাওয়া যায়, বসবাসকারী ডাকাতকে সে দিকে খেয়াল রাখতে হয়। পশ্চিমবঙ্গে এখন শাসক দলের বিভিন্ন গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠীর মধ্যে যেটা চলছে, তাকে ‘অসংগঠিত, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক তোলাবাজি’ বললে মন্দ হয় না। তার চরিত্র ভ্রাম্যমাণ ডাকাতদের মতো। এক দল এসে লুটে নিয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয় দল হানা দিচ্ছে এবং আরও খানিক লুটে নিয়ে যাচ্ছে। তাতে সাময়িক লাভ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য কিছুই আর পড়ে থাকছে না। মুশকিল হল, ম্যানকার ওলসন বর্ণিত ভ্রাম্যমাণ ডাকাতরা এক জনপদ থেকে অন্য জনপদে চলে যেতে পারে— পশ্চিমবঙ্গের তোলাবাজদের পক্ষে সেটা অসম্ভব। এই রাজ্যের ভৌগোলিক সীমানার বাইরে তাদের যাওয়ার উপায় নেই। এই বাধ্যবাধকতা তাদের বসবাসকারী ডাকাতের গোত্রে ফেলেছে। কাজেই, সে রকম আচরণ করাই ভাল। তোলাবাজদের কাছেও শিল্প হল সোনার ডিম পাড়া হাঁস— তাকে এক বারে কেটে ফেলতে নেই। তোলাবাজির দাপটে বিনিয়োগ যদি একেবারে উধাও হয়ে যায়, পরের দিন চলবে কী করে?
পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার, অতএব, দুটো রাস্তা আছে। প্রথম, তোলাবাজি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া। এই পথের কথা বোধ হয় না বলাই ভাল, কারণ কর্মী-সমর্থকদের তোলাবাজির ‘অধিকার’ কেড়ে নিয়েও রাজনীতি করার মতো মেরুদণ্ডের জোর জিনিসটা পশ্চিমবঙ্গে সম্ভবত আর নেই। দ্বিতীয় রাস্তা হল, তোলাবাজিকে সংগঠিত করা। অর্থাৎ, বাম আমলের মডেল ফিরিয়ে আনা। মুশকিল হল, সেই সংগঠিত তোলাবাজিও সম্ভবত বর্তমান শাসকদের আয়ত্তের বাইরে। সিপিএম-এর সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধানতম ফারাক হল, প্রথমটির আঁটোসাটো সাংগঠনিক কাঠামো দ্বিতীয়টির নেই। তৃণমূল অনেক কিছুতেই সিপিএম-এর যোগ্য উত্তরসূরি হতে পেরেছে, কিন্তু সংগঠনের চরিত্রের দিকটিতে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত কংগ্রেসি ঐতিহ্য অনপনেয়। তৃণমূলের স্থানীয় নেতারা অনেক বেশি ‘স্বায়ত্তশাসিত’। এবং, ঠিক সেই কারণেই কোনও কেন্দ্রীয় নীতি তাঁদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া মুশকিল। এমনকী, তোলাবাজির ক্ষেত্রেও। তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে সংগঠিত তোলাবাজির পথে হাঁটা কঠিন। রাজ্যে বিনিয়োগ আনার দ্বিতীয় পথটিও, অতএব, বন্ধ।
ভ্রাম্যমাণ ডাকাতদের উৎপাতই সম্ভবত এই রাজ্যের ভবিষ্যৎ।